নিষেধাজ্ঞা শেষে গত ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে সাগরে পাড়ি জমান কক্সবাজারের জেলেরা। উদ্দেশ্য ছিল রুপালি ইলিশ। তবে এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত এই মাছটি খুব বেশি পরিমাণে ধরতে পারেননি তারা। মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঘাটে ফিরতে শুরু করা বেশিরভাগ ট্রলারেই রয়েছে পাঁচমিশালি সামুদ্রিক মাছ।
জেলেরা জানিয়েছেন, কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলের বিভিন্ন ঘাটে ফিরে আসা ট্রলারগুলোতে রুপচাঁদা, টেকচাঁদা, কালো চান্দা, পোপা, কালো পোপা, মাইট্টা, তাইল্যা, সামুদ্রিক কোরাল, চিংড়ি, লাল চামিলা, ছুরি এবং গুইজ্জা মাছের প্রাচুর্য বেশি। কিছু ট্রলারের জেলেরা সমুদ্রে অল্প পরিমাণে ইলিশ পেলেও সেগুলোর আকার অনেক ছোট। বাজারে এই ইলিশ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে।
জানা গেছে, গত ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে কক্সবাজার জেলার প্রায় সাত হাজার ট্রলার সাগরে যায়। কিছু ট্রলার ইতোমধ্যে মাছ নিয়ে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর ৬ নম্বর ফিশারি ঘাটে পৌঁছতে শুরু করেছে। মাছ নিয়ে ট্রলার আসায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে ঘাটে। ট্রলার থেকে নৌকার সাহায্যে তা অবতরণকেন্দ্রে আনা হচ্ছে।
ঘাটে আসা ‘এফবি মায়ের দোয়া’ ট্রলারের মাঝি আলী আকবর জানান, তিনদিন আগে তারা উপকূল থেকে ৪ ঘণ্টা ট্রলার চালিয়ে বঙ্গোপসাগরে জাল ফেলেন। জালে রাঙা চৈ (লাল কোরাল) গুইজ্জা, তাইল্যা, ফাইস্যা ও কোরালসহ পাঁচমিশালি মাছ পেয়েছেন।
জেলে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ইলিশের চেয়ে সমুদ্রে এখন অন্য মাছ বেশি ধরা পড়ছে। মাঝেমধ্যে কয়েকটি ইলিশও ধরা পড়েছে। তবে সেগুলোর আকার অনেক ছোট।’
জেলেদের আর্থিক সংকট: এদিকে অনেক জেলে দীর্ঘ সময় মাছ ধরতে না পারার কারণে আর্থিক সংকটের কথা জানিয়েছেন।
কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া এলাকার জেলে আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, ‘দীর্ঘদিন সাগরে মাছ ধরা নিষেধ থাকায় সংসারে অভাব চলছিল। ঋণ করে সংসার ও ছেলে মেয়েদের পড়ার খরচ জোগাতে হয়েছে। ভেবেছিলাম নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে গিয়ে বড় বড় ইলিশ পাবো। সেই আশা পূরণ হয়নি। কয়েকদিন পর আবার সাগরে যাবো। ইলিশ ধরা পড়লে তা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করবো। পরিবারে স্বস্তি ফিরবে।’
সাগরে জলদস্যু আতঙ্ক: নতুন বাহারছড়া এলাকার জেলে শাহ আলম বলেন, ‘সাগরে জলদস্যুর বিচরণ বেড়েছে। অনেক সময় মাছ ধরার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তারা। এমনও হয়েছে, ইলিশের আশায় জাল ফেলেছি। জলদস্যুরা ট্রলার নিয়ে এসে আমাদের মারধর করে জাল ও মাছ নিয়ে গেছে। অনেকে প্রাণ বাঁচাতে সাগরে জাল রেখে পালিয়ে এসেছে। সাগরে প্রশাসন নিরাপত্তা বাড়ালে আমরা স্বস্তিতে মাছ ধরতে পারবো। কাঙ্ক্ষিত ইলিশ ধরে পরিবারে শান্তি ফেরাতে পারবো।’
গত বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) ভোরে কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের পশ্চিমে মাছ ধরার সময় বাঁশখালীর ইসমাইল কোম্পানির মালিকানাধীন ‘এফ বি আল্লাহর দয়া’ নামের ট্রলার জলদস্যুদের হামলার শিকার হয়। দস্যুদের গুলিতে ট্রলারের মাঝি মোকাররম মারা যান। এ ঘটনার পর থেকে ১৯ জেলেসহ ট্রলারটি নিখোঁজ ছিল। চার দিন পর ট্রলারের জেলেদের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে পরিবার সূত্রে জানা গেছে।
স্থানীয় বাজারে প্রভাব: ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছের কম সরবরাহের কারণে স্থানীয় বাজার ও ভোক্তাদের বেশি দামে মাছ কিনতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন ক্রেতা।
আরিফুর রহমান নামে এক ক্রেতা জানান, সরবরাহ কম হলে ব্যবসায়ীরা মাছের দাম বাড়িয়ে দেন। এক সময় একটি মাঝারি সাইজের ইলিশ ৬০০ টাকা কেনা গেলেও তা এখন এক হাজার টাকার আশপাশে বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য মাছগুলোর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
মৎস্য ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান জানান, সমুদ্র থেকে বড় ও মাঝারি ট্রলারগুলো ফেরার পর ইলিশের সরবরাহ বাড়বে। সরবরাহ বাড়লে দাম কমে যাবে। ট্রলারগুলো ফিরতে আরো কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান জানান, সামুদ্রিক মাছের প্রজনন সময়ে ৬৫ ও ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার সুফল হিসেবে এবার সাগরে ইলিশ ও অন্যান্য মাছ আকারে বড় হচ্ছে এবং উৎপাদনও বাড়ছে, যা জেলেদের জন্য ইতিবাচক।