১৯৫৩ সালে ৬৮ একর জায়গার ওপর কারখানা এবং ৪৩১ একর আবাসিক জায়গা নিয়ে উপমহাদেশের বৃহত্তম কাগজ কল হিসেবে দেশে প্রথম যাত্রা শুরু করে কর্ণফুলী পেপার মিল। বার্ষিক ৩০ হাজার মেট্রিক টন কাগজ উৎপাদনকারী এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের সরকারি চাহিদার ৭০ ভাগ কাগজ সরবরাহ করতো। কিন্তু কালক্রমে এই প্রতিষ্ঠানটি বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে। একে একে বন্ধ হয়েছে কারখানার প্রায় সব কয়টি বিভাগ। একসময় শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর কেপিএম এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। মৃতপ্রায় এই কারখানাটিকে পূর্ণোদ্যমে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কেপিএম কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) নতুন উদ্যোগ নিয়েছে।
জানা যায়, কেপিএমের যাত্রাকালে মিলটির প্রধান কাঁচামাল বাঁশ আহরণের জন্য সরকারি বন বিভাগ থেকে ৯৯ বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি রাইংখিয়ং ও কাচালং বাঁশ বনের প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার জায়গার লাইসেন্স নেওয়া হয়। বাঁশের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী নদীরে তীরে এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে বাঁশের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর লক্ষ্যে ১৯৯০ সাল থেকে বাঁশের পাশাপাশি পাল্পউড ব্যবহার শুরু হয়। প্রায় সত্তর বছরের পুরনো কর্ণফুলী পেপার মিলের (কেপিএম) ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল।
কেপিএমের এক সমীক্ষায় বলা হয়, ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলে ছয়টি নতুন প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানটির পুরনো জৌলুস ফিরে আনা সম্ভব।
একসময় বাঁশ-পাল্পউডের মাধ্যমে দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে নিজেরাই মণ্ড তৈরি করে কাগজ উৎপাদন করলেও বর্তমানে গত আট বছর ধরে বিদেশ থেকে পাল্প কিনে এনে কাগজ উৎপাদন করছে। অথচ বাঁশ-পাল্পউড ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরিকৃত কাগজে উৎপাদন ব্যয় যেমন কম, তেমনি কাগজও উন্নতমানের। বিদেশ থেকে বেশি দামে পাল্প কিনে এনে উৎপাদন টিকিয়ে রাখতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান আরও বেড়েছে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি বছরে ৩০ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে।
৭০ বছরের পুরানো এ কারখানাটিকে পূর্ণোদ্যমে চালু করতে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কপোরেশন (বিসিআইসি) Waso Engineering প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা কাজ শেষ করেছে।
কেপিএম সূত্রে আরও জানা যায়, ৭০ বছরের পুরনো এই কারখানাটিকে পূর্ণ্যদ্যেমে চালু করতে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) Waso Engineering প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা কাজ শেষ করেছে। যা বর্তমানে বিসিআইসি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাইয়ে রয়েছে। যদি প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে ইন্টিগ্রেডেট পেপার মিলসহ বনায়ন, পেপার ভিত্তিক কেমিক্যাল প্ল্যান্ট, সোডা অ্যাশ, সোডিয়াম সালফেট ও বেসিক কেমিক্যাল প্ল্যান্টসহ (কাস্টিক সোডা, ক্লোরিন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, ব্লিচিং আর্থ, টাইটানিয়াম ডাই অক্সাইড, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, সালফিউরিক অ্যাসিড, ফসফরিক অ্যাসিড ইত্যাদি) এবং সিনথেটিক পলিস্টার ফাইবার প্ল্যান্ট স্থাপন করা যাবে। এতে এই কারখানায় বছরে এক লাখ মেট্রিক টন কাগজ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি বছরে কাগজ উৎপাদন করছে ৩-৫ হাজার মেট্রিক টন।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালে প্রকাশিত বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কেপিএমের যন্ত্রগুলো পুরনো। বড় সংস্কারের কাজ তিন দশক ধরে হয়নি। ঠিকমতো হয় না রক্ষণাবেক্ষণের কাজও। এ কারণে কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম ঘন ঘন ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে লোকসান দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ প্ল্যান্ট বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে। কর্ণফুলী নদী থেকে বাঁশ তুলে যে চিপারের মাধ্যমে বাঁশ টুকরা টুকরা করা হয় সেটি নষ্ট হয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সব মেশিনের গায়ে লাল মরিচা ধরেছে। প্ল্যান্টের ছাদগুলোতে নেই কোনও টিন। বছরব্যাপী বৃষ্টিতে ভিজছে মেশিন আবার রোদে শুকাচ্ছে। পলেস্তারা খসে ক্ষয়ে যাচ্ছে দেয়াল।
ওয়াশিং প্ল্যান্টের পাশে মণ্ড তৈরির প্ল্যান্ট। ২০১৭ সালে থেকে প্ল্যান্টটি বন্ধ। সরেজমিনে দেখা যায়, যন্ত্রগুলো পড়ে আছে। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পচা বাঁশ আর কাঠের টুকরো। দেয়ালের গায়ে জন্মেছে শেওলা। কর্মকর্তারা জানান, এটি বন্ধ থাকায় কাগজ তৈরির পাল্প বা মণ্ড আমদানি করে কর্তৃপক্ষ। ২০১৬ সালে মিলের কেমিক্যাল প্ল্যান্ট (সিসি প্ল্যান্ট) বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৭ সালে বিভিন্ন সমস্যা দেখিয়ে কাগজ উৎপাদনের সব প্ল্যান্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কেপিএম সূত্রে জানা যায়, কেপিএমের ৭১ বছরের ইতিহাসে ৩৩ বছর লাভের মুখ দেখেছে। ২০০৮-০৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ ৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা লাভ করেছিল। তখন কাগজের উৎপাদন ছিল ২৪ হাজার ২০০ টন। এরপর আর লাভের মুখ দেখা যায়নি। বর্তমানে কেপিএমে ৫৬৪ শ্রমিক-কর্মচারী আছেন। বর্তমানে বেতন-ভাতা বাবদ মাসে ১.৫ কোটি টাকা করে বছরে অন্তত ১৫ কোটি টাকা খরচ হয়। প্রতি টন কাগজ উৎপাদনে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয়। কারণ, কেপিএমে এখন প্রতি টন কাগজ উৎপাদনে খরচ হয় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু বিক্রয় মূল্য ৯৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। বেতন-ভাতা, মেরামত, উৎপাদন ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি মিলিয়ে বছরে প্রায় ৩০ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘদিনে কর্মরত শ্রমিকদের সাথে। তাদের দাবি, সুষ্ঠুভাবে কারখানা ব্যবস্থাপনা সম্ভব হলে কেপিএমের পুরনো জৌলুস ফিরে আসবে। প্রতিষ্ঠানটির এক শ্রমিক আব্দুল হাকিম বলেন, গত ৮৮ সাল থেকে আমি এই কারখানায় চাকরি করি। এই কেপিএমে তখন ৫ হাজার মানুষ কাজ করতো, প্রায় ১০০ টন কাগজ উৎপাদন হতো তিন শিফটে। ২৪ ঘণ্টায় কাগজ উৎপাদন হতো। সেই এক সময় ছিল তখন। কিন্তু এখন আস্তে আস্তে সব বিভাগই বন্ধ হয়ে গেছে, শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যাও কমে গেছে।
এই কারখানার শ্রমিকরা এখনো ম্যানুয়ালি কাগজ গুণে কাগজ ফিনিশিংয়ের কাজ করেন। কাগজ প্যাকিজিংয়ের দায়িত্বে থাকা শ্রমিক বলেন, গত ২৪ বছর ধরে রিম ফিনিশিংয়ের কাজ করি। এক সময় প্রতি লাইনে ৮০-৯০ জন করে ছয় লাইনে শ্রমিকরা কাজ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে সব মিলে ২০-২৫ জন শ্রমিক কাজ করছেন।
কর্ণফুলী পেপার মিলে তিনটি মেশিনের মধ্যে দুটিতে সাদা কাগজ এবং অন্যটিতে বাদামী ও অন্যান্য রঙিন কাগজ উৎপাদন করা হয়। কাগজ উৎপাদন বিভাগের দায়িত্বে থাকা আরেক শ্রমিক বলেন, সপ্তাহে ২-৩ দিন কাগজ উৎপাদন হয়, বাকি দিনগুলো বসে থাকি। আমরা চাই আগের জৌলুস ফিরে আসুক কেপিএমে। শুনছি, নতুন একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, সরকার যেন সেটি দ্রুত বাস্তবায়ন করে। এতে আমরা পরিবার নিয়ে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারবো।
কেপিএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ মিলটির অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল অনেক আগেই শেষ হয়েছে জানিয়ে বলেন, কর্ণফুলী পেপার মিলকে পুরোপুরি সচলে ও নতুন ছয়টি প্লান্ট স্থাপনসহ সাতটি প্রকল্প বাস্তবায়নে বিসিআইসি শিল্প মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে। এখন যাচাই-বাছাই চলছে। যদি সরকার এই প্রকল্পটি পাস করে তবে আমরা বছরে এক লক্ষ টন কাগজ উৎপাদন করতে সক্ষম হবো।