ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে বার বার দেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সেখানকার বাসিন্দাদের প্রাণ রক্ষা করছে সুন্দরবন, টেংরাগিরি, শুভসন্ধ্যা ও হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল। তবে, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগে দিন দিন কমছে বনের আয়তন। ফলে, ঝুঁকি বাড়ছে উপকূলের বাসিন্দাদের।
বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলার একটি বরগুনা। এখানকার বাসিন্দারা বলছেন, প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলের বাসিন্দাদের আগলে রাখে সুন্দরবনসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল। তাই, বন রক্ষায় দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপের পাশাপাশি জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা জরুরি।
জলোচ্ছ্বাসের প্রসঙ্গ টেনে স্থানীয়রা বলেন, ২০০৭ সালে আজকের দিনে (১৫ নভেম্বর) ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার বেগে ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস নিয়ে উপকূলে আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন সিডর। সেই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারান। তাদের বেশিরভাগই মারা যান জলোচ্ছ্বাসে।
এ বিষয়ে বরগুনা সদর উপজেলার নলটোনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুজ্জামান মাহফুজ বলেন, ৯০ দশকের পর ঘূর্ণিঝড় সিডরে সবথেকে বেশি মানুষ মারা গেছে বরগুনায়। এমনও পরিবার আছে, যাদের সবাই মারা গেছেন।
সুন্দরবনসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল না থাকলে প্রাণহানি আরও কয়েকগুণ বাড়ত বলে মনে করেন শফিকুজ্জামান মাহফুজ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় সিডরে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা গ্রামে ৬৮ জন মারা যান।
এই এলাকার বাসিন্দা কালো মাঝি বলেন, ঘূর্ণিঝড়সহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের বাসিন্দাদের বুক পেতে আগলে রাখে সুন্দরবন। কিন্তু, সুন্দরবন থেকে প্রতিদিনই চোরাকারবারিরা গাছ কেটে বিক্রি করে দিচ্ছে। এই চক্র সম্পর্কে সবাই জানে। কিন্তু, বছরের পর বছর সুন্দরবন ধ্বংস করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
চরদুয়ানী এলাকার জেলে সোহাগ মোহাম্মদ হাফিজ বলেন, একদিকে চোরাকারবারিরা বন ধ্বংস করছে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সিডরের মতো ঘূর্ণিঝড় আবার হলে অনেক প্রাণহানি হবে।
তালতলী উপজেলার টেংরাগিরি এলাকার বাসিন্দা মো. সুলতান বলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে টেংরাগিরি বনে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। তিন বছরে বনের কয়েক লাখ গাছ পড়ে গেছে। এখন ভাঙনের কবলে পড়েছে পুরো বনাঞ্চল।
নলবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা রাজু মিয়া বলেন, শুভসন্ধ্যা সংরক্ষিত বন। বছরের পর বছর ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষা করে আসছে। অথচ, এই বনের গাছ কেটে বিক্রি করে দিচ্ছে বনদস্যুরা। গাছ কাটা বন্ধ না হলে ধ্বংস হয়ে যাবে এই বনাঞ্চল। হুমকিতে পড়বে জীববৈচিত্র্য।
এলাকাবাসী বলেন, সুন্দরবনসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কারণে উপকূলবাসী ঝড়ো বাতাস থেকে রক্ষা পেলেও জলোচ্ছ্বাসে অস্থায়ী বেড়িবাঁধ ভেঙে বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জনপদ। তাদের দাবি, দুর্যোগের পরে ত্রাণ নয়; প্রাণ বাঁচাতে আগেই টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা দরকার।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব বলেন, বরগুনা উপকূল রক্ষায় বনের পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, গত ২৫ বছরে বাংলাদেশে সুন্দরবনের আয়তন কমেছে ১০ হাজার ৯৮০ হেক্টর। ভাঙনের কারণে প্রতি বছর বনের আয়তন ৬ কিলোমিটার কমছে। ২০০৭ সালের সিডরে সুন্দরবনের প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে।