সারা বাংলা

স্থগিতের পরও ১২ বছর ধরে বেতন পাচ্ছেন ৭ শিক্ষক

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার ফুলহারা আঞ্চলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সাতজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে জাল সনদ দিয়ে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ১২ বছর ধরে তারা বেতনও উত্তোলন করে আসছেন। 

বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) তদন্ত প্রতিবেদনে সাত শিক্ষকের জাল সনদের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। পরে শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ওই শিক্ষকদের বেতন ভাতা স্থগিতসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিকে নির্দেশ দিলেও এখনো বেতন পাচ্ছেন ওই সাতজন শিক্ষক। 

তবে শিক্ষকরা ২০০৪ সালে ভুয়া নিয়োগের কাগজপত্র সংযোজন করে হাইকোর্টে দাখিল করে ১১ বছর ধরে বেতন তুলছেন বলে দাবি করেছেন ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি মো. শাজাহান মজনু। 

তার ভাষ্যমতে, ২০০৪ সালে ওই সাত জনের নিয়োগপত্র সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে স্বাক্ষর করেননি। তাদের নিয়োগ হয়েছে ২০১৩ সালে। কিন্তু তার স্বাক্ষর জাল করে ওই সাতজন শিক্ষক নথিপত্র হাইকোর্টে দাখিল করেছেন। এমনিতেই ভুয়া কাগজে চাকরি নিয়ে ধরা খেয়েছেন। সেই ভুয়া চাকরি বাঁচাতে এখন আমার স্বাক্ষরও জাল করেছেন।

অনুসন্ধান বলছে, বিগত ২০১৩ সালের নিয়োগকে গোপন করে ২০০৪ সালের বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে ভূয়া নিয়োগপত্র বানিয়ে উচ্চ আদালতে শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশনার বিরুদ্ধে রিট পিটিশিন দাখিল করেন জাল সনদধারী শিক্ষকরা। ফলে তাদের বেতন ভাতা উত্তোলনসহ পাঠদানের পথটি সহজ হয়ে যায়। উচ্চ আদালতে রিট পিটিশিন করেই বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে বহাল রয়েছেন। সম্প্রতি অবৈধ সুপারিশ না করায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে তালা ঝুলিয়েছেন তারা।

জাল সনদধারী সহকারী শিক্ষকরা হলেন- সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি) শাহীনুর ইসলাম, সহকারী শিক্ষক (সমাজিক বিজ্ঞান) মর্জিনা আক্তার, সহকারী শিক্ষক (বাংলা) শামছুন নাহার, সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি) আয়শা আক্তার, সহকারী শিক্ষক (বাংলা) মো. আবুল কাশেম মোল্লা, সহকারী শিক্ষক (সমাজিক বিজ্ঞান) মো. বশির উদ্দিন এবং কম্পিউটার সনদ জালধারী কম্পিউটার শিক্ষক শাহানাজ আক্তার।

স্কুলের দাতা সদস্য মো. নবুয়াত আলীর দেওয়া লিখিত অভিযোগে জানা যায়, মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার ফুলহারা আঞ্চলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে বিগত ২০১৩ সালে শিক্ষাবিধি অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকসহ মোট ১০ জন শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সহকারী শিক্ষক পদে ছিলেন সাতজন। নিয়োগের কিছুদিন পরে ছয়জন সহকারী শিক্ষকের শিক্ষক নিবন্ধন সদন জাল ও একজন কম্পিউটার শিক্ষকের সনদ ছাড়াই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দেন নবুয়াত আলী। 

সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) ওই ছয়জন শিক্ষকের নিবন্ধন সনদ জাল উল্লেখ্য করে শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর প্রতিবেদন প্রেরণ করে। পরে শিক্ষা অধিদপ্তর স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিকে ওই ছয়জন শিক্ষকের সনদ জাল হওয়ায় তাদের বেতন ভাতা স্থগিত করাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়।

এরপর চাকরি বহাল ও বেতন ভাতা চালু রাখতে জাল সনদধারী ছয়জন শিক্ষক ২০১৩ সালে নিয়োগ গোপন করে বিগত ২০০৪ সালে ওই বিদ্যালয়ের সাবেক ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শাজাহান মজনুর স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া নিয়োগপত্র তৈরি করে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন। সেই রিটের বলে এখন পর্যন্ত বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেব বহাল রয়েছেন এবং নিয়মিত বেতন ভাতা উত্তোলন করে আসছেন।

সম্প্রতি ওই সাতজন শিক্ষক বেতনের সিনিয়র স্কেল আবেদন করার জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নিকট সুপারিশ চান। কিন্তু জাল সনদধারী এসব শিক্ষকদের সুপারিশ না করায় প্রধান শিক্ষকের ওপর ক্ষুদ্ধ হন তারা। এর পর স্কুলের প্রধান শিক্ষককে নানাভাবে ভয়ভীতি, হুমকি-ধামকিসহ চাঁদা দাবি করার অভিযোগও ওঠে পরবর্তীতে ওই শিক্ষক ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে। সুপারিশ না করায় ওই শিক্ষকরা গত ১২ নভেম্বর বিকেলে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন। এতে স্কুলের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকেরা।

এদিকে ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির প্রাক্তন সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে ২০০৪ সালের ভূয়া নিয়োগপত্র বানানোর অভিযোগ এবং তদন্ত করে স্কুলের জাল সনদধারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিতভাবে গত ৭ নভেম্বর আবেদন করেন ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির প্রাক্তণ সভাপতি মো. শাজাহান মজনু।

নিয়োগ কমিটির সভাপতি মো. কবির খান বলেন, ‘বিধি অনুযায়ী ২০১৩ সালে ওই শিক্ষকদের নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়েছিল, তবে তাদের সনদ যাচাই-বাছাই করার কোনো সুযোগ ছিল না আমাদের। কিন্তু তাদের সনদ জাল প্রমাণিত হওয়ায় ২০০৪ সালের ভূয়া নিয়োগপত্র বানিয়ে এখনো স্কুলে শিক্ষক হিসেবে আছেন।’

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির প্রাক্তন সভাপতি মো. শাজাহান মজনু বলেন, ‘শুনেছি আমার স্বাক্ষর জাল করে ২০১৩ সালের শিক্ষক নিয়োগ দেখানো হয়েছে ২০০৪ সালের। অথচ আমি ওই স্কুলের চার বারের নির্বাচিত সভাপতি ছিলাম। ২০০৯ সাল পর্যন্ত ম্যানেজিং কমিটির দায়িত্ব পালন করেছি। ওই সাতজন শিক্ষকের নিয়োগ আমার সময়ে হয়নি বরং শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে ২০১৩ সালে। তবে ২০০৫ সাল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষকদের নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক হওয়ায় এবং তাদের সনদ জাল হওয়ায় কৌশলগত কারণে তার স্বাক্ষর জাল করে ওই শিক্ষকরা ২০০৪ সালের নিয়োগ দেখিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।’

এদিকে জাল সনদে চাকরি নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত সাত শিক্ষকদের পক্ষে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বশির উদ্দিন বলেন, ‘ফুলহারা আঞ্চলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ২০০৪ সালে নিয়োগ পেয়েছি। তবে নিয়োগের সময় কোনো শিক্ষক নিবন্ধন সনদ নিয়োগ কমিটির কাছে জমা দেইনি। আমিসহ বাকি শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো ভুল নেই। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভুল তথ্য প্রচার করছে।’

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ‘জাল সনদ দিয়ে ও স্কুলের প্রাক্তন সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। আমরা তদন্ত করব এবং তদন্ত ওই শিক্ষকদের নিবন্ধন সনদ জাল পাওয়া গেলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাধ্যমিক স্কুল পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারী বিধি-বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।’