সারা বাংলা

‘বিচার কার কাছে চাইব, ছেলের একটা চাকরি চাই’

স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার ছিল আব্দুল গণির। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় মাথায় গুলি লেগে মারা যান তিনি। এর পর তার সংসারে নেমে এসেছে শোক আর দারিদ্রের কালো ছায়া।

তার স্ত্রী লাকী আক্তারের আকুতি, ‘‘স্বামী হত্যার বিচার কার কাছে চাইব? বিচার চাই না; সংসার বাঁচাতে এখন ছেলের একটা চাকরি চাই।’’

নিহত আব্দুল গণি রাজবাড়ী সদর উপজেলার আলীপুর ইউনিয়নের রহিমপুর গ্রামের মজিদ শেখের ছেলে। ঢাকার গুলশান-২ এলাকার আবাসিক হোটেল ‘সিক্সসিজন’-এ কাজ করতেন। গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বাড্ডার ভাড়া বাসা থেকে হোটেলে যাওয়ার সময় গুলিতে নিহত হন তিনি। ২৬ জুলাই শুক্রবার বিকেলে তার গ্রামের বাড়ি রহিমপুরে মিলাদ অনুষ্ঠিত হয়।

আব্দুল গণির স্ত্রী জানান, ১৫ বছর ধরে ঢাকার গুলশানের সিক্সসিজন হোটেলে চাকরি করতেন আব্দুল গণি। থাকতেন বাড্ডায় একটি ভাড়া বাসায়। ছেলে আলামিন এসএসসি পাশ করার পর ঢাকায় চলে যায়। সেখানে সে ‘শেফ’ এর কাজ শিখছিল।

সম্প্রতি রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানখানাপুর ইউনিয়নের চরখানাখানাপুর এলাকায় বাড়ি করেন গণি। সেখানেই থাকতেন স্ত্রী লাকী আক্তার ও চার বছরের মেয়ে জান্নাতকে নিয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে আব্দুল গণি বাড়ি যেতেন। আব্দুল গণি যা আয় করতেন তা নিয়ে সংসারে টানাপড়েন থাকলেও সুখের কমতি ছিল না।

গত ১৯ জুলাই সকালে রাজধানী ঢাকার গুলশান এলাকায় আন্দোলন সংঘর্ষের মাঝে পড়ে মাথায় গুলি লেগে মারা যান আব্দুল গণি। ২১ জুলাই রোববার ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে তার মরদেহ হাতে পান স্বজনরা। ওইদিন রাতেই তাকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।

আব্দুল গণির বাবা মজিদ শেখ জানান, গত ১৯ জুলাই শুক্রবার সকালে ছেলের সাথে ফোনে কথা হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একজন তাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে আপনার ছেলে কি ঢাকা থাকে? তিনি হ্যাঁ বললে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলে আপনার ছেলের গুলি লেগেছে। হাসপাতালে আছে। ঢাকায় কেউ থাকলে পাঠিয়ে দেন।

ক্রন্দনরত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘‘আমার আরেক ছেলে ঢাকায় থাকে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফোন করে হাসপাতালে যেতে বলি। আমার ছোট ছেলে হাসপাতালে যাওয়ার পরই জানতে পারেন গণি আর নেই। ছেলে হারানোর কষ্ট বুকে চেপে রয়েছি। চার বছর বয়সে আমার নাতনি এতিম হয়ে গেল! তার করুণ মুখের দিকে তাকাতে পারি না।”

আব্দুল গণির স্ত্রী লাকী আক্তার বলেন, ‘‘আমার স্বামী খুব সহজ সরল ছিল। কারও সাথে কোনো দিন তার ঝামেলা হয়নি। সে কোনো রাজনীতিও করত না। ছেলে-মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে সুখেই ছিলাম। স্বামীর মৃত্যুতে আমার সুখের সংসার শেষ হয়ে গেল। সংসার চালাতে গিয়ে অনেক টাকা ঋণী হয়ে গেছি। এসব টাকা শোধ করব কীভাবে?

‘একেতো স্বামীর মৃত্যু শোক, আরেক দিকে সংসার আর ঋণের চাপে চোখে অন্ধকার দেখছি। সংসারে হাল ধরার মতো কেউ নেই। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই না। সংসার যেন চালাতে পারি এজন্য ছেলের একটা চাকরি চাই। দু’বেলা দু’মুঠো অন্তত খেয়ে যেন বাঁচতে পারি।”

আব্দুল গণির ছেলে আলামিন শেখ জানায়, এসএসসি পাশের পর তার বাবা তাকে ঢাকা নিয়ে যায়। সেখানে শেফের কাজ শিখছে। বাবার সাথে একই বাসায় থাকত। আগের রাতে কাজ শেষ করে সকালে বাসায় ফিরে এসে ঘুমিয়েছিল আলামিন। সকাল ১০টার দিকে মা ফোন দিয়ে বলে তোর বাবার খবর নে। মাথায় গুলি লেগেছে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে বাবার মরদেহ দেখতে পান আলামিন।

আলামিন বলেন, “ওইদিন হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয় বাবার লাশ। ২১ জুলাই রোববার ময়নাতদন্তের পর বাবার মরদেহ বুঝে পাই। আমি ঢাকায় শেফের কাজ শিখছিলাম। এখন বেকার। বাড়িতে মা আর ছোট বোন। বাবাকে হারিয়ে আমরা খুবই অসহায় হয়ে পড়েছি।”