দেশের পোশাক খাতের অগ্নি দুর্ঘটনার ভয়াল স্মৃতির নাম তাজরীন ট্রাজেডি। বেঁচে ফেরা অনেকেই আর ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে। এখনও পূনর্বাসিত না হওয়ায় আক্ষেপ আহতদের। ওই ঘটনার ১২ বছর পূর্তি আজ। সেই দৃশ্য আজও মনে পড়লে আঁৎকে ওঠেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর, অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের মতো এ দিনেও সকালে কাজে যোগ দিয়েছিলেন আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টস কারখানার হাজারো শ্রমিক। সন্ধ্যায় হঠাৎই ভবনের আটতলায় আগুনের সূত্রপাত। মুহূর্তে তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে। জীবন বাঁচাতে কেউ কেউ লাফিয়ে পড়েন। শ্রমিকদের বাঁচার আকুতিতে ভারি হয়ে ওঠে নিশ্চিন্তপুরের আকাশ-বাতাস। তবে অনেকেই হন পুড়ে অঙ্গার।
‘এমন দৃশ্য জীবনে দেখিনি’
সন্ধ্যার দিকে লাগা সেই আগুনের ঘটনা আজও মনে পড়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের। সেদিন বাড়িতে ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ কামরুল হাসান। তিনি বলেন, “প্রায় ১৩ বছর ধরে আমি এখানে থাকি। ঘটনা যখন ঘটে, আমি পাশেই ছিলাম। আমার ঘরও পুড়ে যায়। কিছুই বের করতে পারিনি। বহু দুর্ঘটনা দেখছি। কিন্তু এত বড় দুর্ঘটনা জীবনে দেখিনি। কি যে হাহাকার মানুষের। মানুষকে কোনো সহায়তা করার কিছু ছিল না। মানুষ বাঁচার জন্য এত কিছু করলো। কিন্তু বাঁচতে পারেনি। তারা কাজ করছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন আগুন লাগল সন্ধ্যার দিকে। সারা রাত ধরে সেই আগুন জ্বলছিল। অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ সারা রাত। মানুষ এমনভাবে লাফিয়ে পড়ছে। ওয়ালের ওপর পড়ছে। রডের ওপর পড়ছে। আর বাঁচার কি আকুতি। কাকুতিমিনতি করছে।”
নজরুল ইসলাম নামে আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “আগুনের কথা শুনে তো দৌড়ে এখানে আসি। এসে দেখি দাউদাউ আগুন জ্বলছে। তাপ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশেও। অনেকেই চালের ওপর লাফিয়ে পড়েছে। অনেকেই পুড়ে মারা যায়। বীভৎস সেই দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে।”
পোড়া শরীর, পঙ্গু দেহ নিয়ে জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা
সেদিনের আগুনের লেলিহান শিখা আজও ভয়াবহ হয়ে চোখে ফেরে ভুক্তভোগী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের কাছে। আহত শ্রমিকরা অনেকে সাময়িক সহযোগিতা পেলেও পূর্ণাঙ্গ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসিত হতে না পেরে অনেকের জীবনে নেমে এসেছে বেঁচেও মৃত্যু কামনার মত যন্ত্রণা। পোড়া শরীর, পঙ্গু দেহ নিয়ে জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। জীবিকা নির্বাহে অনেকেই শুরু করেছেন নতুন পেশা। তাদের চাওয়া, এ স্থানে কারখানাটি ফের চালু, আহত শ্রমিকদের বাসস্থান অথবা কোনো কর্মসংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক।
এমনই একজন সবিতা রানি। তাজরিনের সুইং অপারেটর ছিলেন। ভালো বেতন পেতেন। ঘটনার দিন তৃতীয় তলায় ছিলেন তিনি। সন্ধায় হঠাৎ বেজে ওঠা কারখানার ফায়ার অ্যালার্মে ভয় ঢোকে তার ভেতর। একসময় আগুনের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে পুরো ফ্লোরে। এরপর অনেকের সঙ্গে তিন তোলা থেকে লাফিয়ে পড়েন তিনি। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে শুরু হয় তার অনিশ্চিত জীবনের পথচলা।
তিনি জানান, দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে পেটের দায়ে কাজে ফিরেছেন তিনি। তবে কারখানায় কাজ করার মত শারীরিক ক্ষমতা হারিয়েছেন ততদিনে। তবুও কারখানায় ঘুরেও কাজ না পেয়ে আহত শ্রমিকদের কয় জনকে নিয়ে কারখানা শুরু করেছিলেন, তবে পুঁজির অভাবে সেটা সম্ভব হয়নি।
সবিতা বলেন, “অনেক কষ্টে একটা সেলাই মেশিন কিনে বাসায় টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করছি। আমার দিন খুব কষ্টে যাচ্ছে। ভারি কোনো কাজ করতে পারি না। ব্যথার যন্ত্রণায় প্রতিদিন রাতে কান্না করে ঘুমাই। ঘুম নাই, চলার নাই। পরিবারের ওপর বোঝা হয়ে গেছি। এ জীবন থাকার চেয়ে না থাকা ভালো।”
তিনি বলেন, “দুর্ঘটনার পর সরকার তাদের যে সাহায্য করেছে তা চিকিৎসার পেছনেই শেষ হয়ে গেছে। আমরা সাহায্য চাই না, ক্ষতিপূরণ চাই। তাই আমরা ভালোভাবে সুস্থভাবে চলতে পারি সরকার ও বিজিএমইএ যেন তাদের জন্য এধরনের ব্যবস্থা করে। সরকার আশ্বাস দিয়েছে, এগুলো বাস্তবায়ন করলে তাও একটু বাঁচতে পারবো। যারা মরে গেছে তারাই বেঁচে গেছে, আমরা যারা বেঁচে আছি, দেহটা ধুঁকে ধুঁকে শেষ। ১২ বছর চলে গেল, এখনও কিছু পেলাম না।”
সীমা আক্তার নামে আরেক শ্রমিক বলেন, “তাজরীন গার্মেন্টসের জায়গাটি ১২ বছর ধরে এভাবে ফেলে রেখেছে। এটি হয় চালু করুক, না হয় আমাদের থাকার জায়গা করে দিক। আমরা তো কাজ করতে পারছি না। আমরা কোনো সহযোগিতা পাইনি। কিছু টাকা পেয়েছি। কিন্তু আর কাজ করতে পারি না। আমরা কি মানুষ না, আমাদের কি বাঁচার অধিকার নাই। আমাদের দিকে দেখার কেউ নেই। নতুন সরকারের কাছে আশা এটাই যে, তারা আমাদের দিকে তাকাবে। আমাদের বিচারের দাবি পূরণ করবে। নভেম্বর এলে ডাকাডাকি করে অনেকে। কিন্তু কিছু পাই না। ঘর ভাড়া, দোকান বাকি দিতে পারি না, ওষুধের টাকা নাই। আগুনের ঘটনায় জীবনটাই শেষ হয়ে গেছে।”
নিহতের পরিবারকে সহায়তা, আহতদের চিকিৎসার দাবি শ্রমিক নেতাদের
আহত হয়ে এক দিকে শারীরিকভাবে অক্ষম, অন্যদিকে কর্মহীনতায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া শ্রমিকদের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ও এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবি জানান শ্রমিক নেতারা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, “নিশ্চিন্তপুরে অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিক নিহতের ঘটনা ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা দেখছি শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন হয়নি। সহযোগীতা করা হয়েছে, কিন্তু সঠিক পুনর্বাসন হয়নি। তারা কষ্টে জীবনযাপন করছে। চিকিৎসা হচ্ছে না। সরকার যাতে দ্রুত উদ্যোগ নেয়। তাদের যাতে পুনর্বাসন হয়।”
বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের (বিজিএসএফ) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি অরবিন্দু বেপারী (বিন্দু) বলেন, “২০১২ সালে তাজরীন গার্মেন্টসে আগুন লাগে। মালিকপক্ষ সুপরিকল্পিতভাবে অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটায়। আজ পর্যন্ত মৃত শ্রমিকদের স্বজনরা ক্ষতিপূরণ পায়নি। আহত শ্রমিকরা সুচিকিৎসা পায়নি। সহযোগিতা পায়নি। এখানে হত্যাকাণ্ড ঘটালেও আগের সরকার মালিককে নামমাত্র গ্রেপ্তার করে, তারপর সে জামিন পায়। এরপর সে আওয়ামী মৎসজীবি লীগের সভাপতি হয়ে দাপট দেখিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানাই, আগের সরকারের আমলে শ্রমিক হত্যার বিচার হয়নি। এই সরকার তদন্ত করে শ্রমিক হত্যার বিচার করবে।”