সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, উল্লাপাড়া, রায়গঞ্জ ও শাহজাদপুর উপজেলার চলনবিল এলাকায় গড়ে উঠেছে শতাধিক শুঁটকির চাতাল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব চাতালে মাছ কাটা থেকে শুরু করে পরিষ্কার, ধোয়া এবং রোদে শুকানোর কাজ করেন শ্রমিকরা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কঠোর প্ররিশ্রমের এ কাজে মজুরি নিয়ে খুশি নন নারীরা। পুরুষের সমান কাজ করেও তারা মজুরি পান অর্ধেক।
জানা যায়, জেলার চারটি উপজেলায় মিঠা পানির দেশীয় মাছের শুঁটকি উৎপাদন হয়। অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে শুঁটকি উৎপাদন। এই মৌসুম চলবে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত।
মৎস্যজীবীদের ভাষ্য, চলনবিলে এ বছর দুই দফায় বন্যার পানি এসেছে। ফলে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় প্রজাতির মাছ ধরা পড়েছে জেলেদের জালে। পুঁটি, খলসে, চেলা, টেংরা, কই, মাগুর, শিং, বাতাসি, চিংড়ি, নলা, টাকি, গুচিবাইম, বোয়াল, ফলি, কাতল, লওলা, শোল, গজারসহ নানা জাতের মাছ ধরা পড়ে এই বিলে।
চাতাল শ্রমিকরা জানান, কোনো প্রকার রাসায়নিকের মিশ্রণ ছাড়াই শুধু লবণ যুক্ত করে মাছ সূর্যের আলোয় শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়। এই শুঁটকি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ভারত ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। শুঁটকি উৎপাদনে এ অঞ্চলের চাতালগুলোতে এখন কর্মব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন প্রায় পাঁচ শতাধিক শ্রমিক।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, উৎপাদনকারীরা মাছের আকার এবং মানভেদে শুঁটকির দাম নির্ধারন করেন। পাইকারি বাজারে তারা ২০০ থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকা কেজিতে শুঁটকি বিক্রি করেন। ভোক্তা পর্যায়ে এর দাম আরো বেশি। বিশেষ করে বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন শুঁটকির দাম বাড়ে কয়েক গুণ। শুঁটকির মধ্যে বোয়াল ২ হাজার, বড় শোল ১৬০০-১৮০০, বড় টাকি ১৪০০-১৬০০, মাঝারি টাকি ১০০০-১২০০, ছোট টাকি ৭০০-৮০০, ছোট গুলসা ৭০০-৮০০, চিংড়ি ৫০০-৬০০, বাইম ৬০০-৭০০ এবং বিভিন্ন আকারের পুঁটির শুঁটকি ৩০০-৬০০ টাকা পর্যন্ত কেজি দরে পাইকারি বিক্রি করতে পারেন চাতাল মালিকরা বলে আশা করা হচ্ছে।
উল্লাপাড়ার বড় পাঙ্গাসী গ্রামের বাসিন্দা জয়ন্তী দাস বলেন, “সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুঁটকির চাতালে কাজ করি। অথচ প্রতিদিন মজুরি পায় ২০০ টাকা। আমাদের থেকে অনেক পরে পুরুষ শ্রমিকরা কাজে আসেন। তাদের দৈনিক মজুরি দেওয়া হয় ৪০০ টাকা।”
তাড়াশের নওগাঁ ইউনিয়নের দেবিপুর গ্রামের বাসিন্দা ছকিনা খাতুন বলেন, “পাঁচ জনের সংসার আমার। আমার উপার্জনের ওপর পুরো সংসার নির্ভরশীল। স্বামী মানসিক প্রতিবন্ধী। কোনো কাজ করেন না। তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হয়। তিন সন্তান পড়ালেখা করে। চাতালে একই সমান কাজ করে পুরুষ পায় ৫০০ টাকা প্রতিদিন। আমি পাই মাত্র ২০০ টাকা। বাজারে প্রতিটি জিনিসের দাম অনেক। ২০০ টাকা দিয়ে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়।”
তাড়াশ উপজেলার মাগুরা বিনোদ ইউনিয়নের ললুয়াকান্দি গ্রামের আবু হানিফের স্ত্রী মাজেদা খাতুন বলেন, “স্বামী বেঁচে থাকলেও আমার ভরণপোষণ দেন না। গত ১৫ বছর ধরে শুঁটকির চাতালে কাজ করছি। দিন শেষে যে টাকা পাই তাই দিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে।”
অপর নারী শ্রমিক শাহিনুর বেগম বলেন, “পরিবারে অভাব থাকায় চাতালে কাজ করি। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর সন্ধ্যায় মালিক ২০০ টাকা দেন। সারাদিন পুরুষের সমান কাজ করে অর্ধেক মজুরি পেলে অসহায় লাগে। মজুরি বাড়ানোর জন্য মালিকপক্ষের কাছে অনেকবার বলেছি। তারা আমাদের কথা আমলে নেননি। অর্ধেক মজুরিতেই তাই কাজ করতে হচ্ছে। কাজের ন্যায্য মজুরি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।”
চলনবিলের শুঁটকি ব্যবসায়ী মজিবুর রহমান বলেন, “এ অঞ্চলের শুঁটকি মাছের মান ভালো। খেতেও সুস্বাধু। তাই দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলনবিলের শুঁটকি মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। শুঁটকি ব্যবসায় জড়িত হয়ে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতার দেখা পাচ্ছি। তবে এ ব্যবসায় ঝুঁঁকিও অনেক বেশি।”
বিনায়েকপুর গ্রামের পুরুষ শ্রমিক গফুর শেখ বলেন, “চাতাল মালিকরা ব্যক্তি মালিকানার জায়গা লিজ নিয়ে চলনবিল অঞ্চলের শুঁটকির চাতাল তৈরি করেন। মাছের আকারভেদে শুঁটকির দাম হয় ভিন্ন ভিন্ন। ছোট আকারের মাছের শুঁটকি প্রতিমণ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর বড় আকৃতির মাছের শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা মণ দরে।”
উল্লাপাড়ার বড় পাঙ্গাসী গ্রামের চাতাল মালিক বায়েজিত হোসেন নারী শ্রমিকদের কম মজুরির কথা স্বীকার করেন জানান, আগে একজন চাতাল মালিক ন্যূনতম ২০ থেকে ২৫ টন শুঁটকি উৎপাদন ও বিপণন করেছেন। দুই-তিন বছর ধরে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ অঞ্চলে বরাবরই নারী শ্রমিকদের মজুরি কম ছিল। তারা সেভাবেই মজুরি দিচ্ছেন। নারী শ্রমিকদের দাবি পূরণে চাতাল মালিকরা আন্তরিক। শুঁটকির উৎপাদন বাড়লে বিষয়টি যথাযথ মূল্যায়ন করা যাবে।
শুঁটকি উৎপাদনকারী মোতাহার হোসেন জানান, কয়েক বছর ধরে পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছ না পেয়ে লোকসান গুনছেন তারা। বছরে ছয় মাস এ কাজ করতে পারেন তারা। চলনবিলে এখন ফেব্রুয়ারি মাসের শেষেই পানি শুকিয়ে যায়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় তাদের কার্যক্রম। তারা লাভবান হলে নারী শ্রমিকদের মজুরিও বাড়াবেন।
স্বেচ্ছাসেবী বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনের উপ-পরিচালক মোছা. রোখসানা খাতুন বলেন, “প্রায় সব কাজেই মজুরি বৈষম্যের শিকার নারী। এর মূল কারণ আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অবদান ছোট করে দেখা হয়। অতিদ্রুত আমি নিজেই শুঁটকির চাতালে যাব। নারী শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো নিয়ে শুঁটকি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলব।”
তাড়াশের মহিষলুটি শুঁটকি আড়তের সভাপতি মজনু সরকার বলেন, “বর্ষা মৌসুমে চলনবিলে প্রচুর পরিমাণে শুঁটকি তৈরি হয়। সংরক্ষণাগার না থাকায় বছরজুড়ে শুঁটকি তৈরি সম্ভব হয় না। এ কারণে চলনবিলে উৎপাদিত শুঁটকি প্রস্তুতের পরই সৈয়দপুরের পাইকারি মোকামে বিক্রি করা হয়। পাইকারদের কাছে বিক্রি না করে সরাসরি বিদেশে রপ্তানি করতে পারলে উৎপাদনকারীরা অধিক লাভবান হতেন। সংরক্ষণাগার তৈরির পাশাপাশি সরাসরি বিদেশে শুঁটকি রপ্তানিতে সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করছি।”
সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শাহীনুর রহমান বলেন, “জেলার চারটি উপজেলায় গত বছর ৩১৭ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদন হয়েছে। এ বছর প্রায় ৩৫০ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আছে। মৎস্য ভাণ্ডার খ্যাত চলনবিলের দেশি মাছ সুস্বাদু ও মানসম্পন্ন হওয়ায় বিদেশের বাজারে এই মাছের শুঁটকির চাহিদা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে শুঁটকির উৎপাদনও।”
তিনি আরো বলেন, “নারী শ্রমিকদের মজুরি কম দেওয়ার বিষয়টি অবগত হয়েছি। তাদের মজুরি বৃদ্ধির ব্যাপারে উপজেলা মৎস্য বিভাগ থেকে চাতাল মালিকদের সঙ্গে কথা বলা হবে।”