পাবনায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বাউত উৎসবে মাছ শিকারে মেতেছেন সৌখিন মৎস্য শিকারিরা। পলো, জালসহ বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে দল বেঁধে বিলে দুর-দূরান্ত থেকে আসেন বিভিন্ন বয়সী হাজারো মানুষ। কিন্তু এবছর কাঙ্ক্ষিত মাছের দেখা না পেয়ে হতাশ মৎস্য শিকারিরা। তাদের অভিযোগ, প্রভাবশালীরা চায়না জাল আর গ্যাস ট্যাবলেট দিয়ে মাছ ধরে নেয়ায় বছর বছর কমছে মাছের উৎপাদন। ফিকে হয়ে আসছে বাউত উৎসবের রঙ।
ভাঙ্গুড়া উপজেলার রুহুল বিলে বাউত উৎসবে এবারের পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে শনিবার (৩০ নভেম্বর) ভোর ৬টায় বিলে হাজির হন এ প্রতিবেদক।
পাবনা-ফরিদপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের কোল ঘেঁষে পাটুলিপাড়া দাখিল মাদ্রাসা। সেই মাদ্রাসা সংলগ্ন চিকন পাকা রাস্তা ধরে কিছুদূর এগুলেই বামে কাঁচা রাস্তা নেমে গেছে রহুল বিলে। দূর-দূরান্ত থেকে বিভিন্ন যানবাহনে আসতে শুরু করেছে মানুষ। আকাশ মেঘলা থাকায় তখনও সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। বিলের মুখে ঢুকতেই খাবারের দোকান সাজিয়ে বসেছেন কয়েকজন। সেখানে অল্প দামে পাওয়া গেল খিচুরি, রুটি, ডিম ও ডাউল। অনেকে সেরে নিচ্ছেন সকালের নাস্তা।
হেমন্তের সকালে মেঘ সরিয়ে ঝলমলে সূর্যের মুখ দেখার সাথে সাথেই বিলপারে হাজির নানা বয়সী হাজারো মানুষ। সবার হাতে পলো, বিভিন্ন রকম জালসহ মাছ ধরার নানান উপকরণ। বিলের ময়লা আবর্জনায় ভরা পানি থেকে ত্বক রক্ষায় অনেকে শরীরে সরিষার তেল মালিশ করে নিচ্ছেন। কেউ আবার সকালের মিষ্টি রোদে একটু আরাম করে শরীর গরম করে নিচ্ছেন।
এক পর্যায়ে হঠাৎ হই হই করে বিলের পানিতে নেমে পড়েন বাউতেরা। মৎস্য শিকারিদের আঞ্চলিক ভাষায় বাউত বলা হয়। তারপর একসঙ্গে বিলে নেমে লোকজ রীতিতে মনের আনন্দে চলে মাছ শিকার। দল বেঁধে মাছ শিকারের এই আয়োজনের নামই মূলত বাউত উৎসব-এমনটাই জানালেন মাছ শিকারে আসা ফরিদপুর উপজেলার চিথুলিয়া গ্রামের প্রবীণ মাছ শিকারি আব্দুল সালাম।
স্থানীয়ভাবে আলাপকালে জানা যায়, চলনবিল অঞ্চলে এমন উৎসব চলছে প্রায় শত বছর ধরে। পাবনার রুহুল বিল, ডিকশির বিল, রামের বিলসহ বিভিন্ন বিলে চলে এই বাউত উৎসব। নভেম্বর মাসের শেষে অথবা ডিসেম্বর মাসের প্রথমদিকে শুরু হয় মাসব্যাপী মাছ শিকারের এই উৎসব। নির্ভর করে বিলে পানি কতটুকু থাকে তার ওপর। প্রতি সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার ভোর থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত চলে মাছ শিকার।
মাছ না পেয়ে অনেকে বিল থেকে উঠে আসেন। তখন কথা হয় কয়েকজনের সাথে। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ থেকে আসা মৎস্য শিকারি আব্দুল মোমিন (৪৫) বলেন, “অনেকবছর ধরেই এখানে বাউত উৎসবে আসি। কমবেশি ভাল মাছ পাই। কিন্তু এবারের অবস্থা খুব খারাপ। মাছ নাই বললেই চলে।”
চাটমোহর উপজেলার পার্শ্বডাঙ্গা গ্রামে মৎস্য শিকারি আকবর আলী (৬৫) বলেন, “প্রায় ৪০ বছর ধরে মাছ ধরি। এখানে প্রত্যেক বছরই আসি। মাছ পাওয়া না পাওয়া ওডা সমস্যা লায়। সবাই যে একসাথে আনন্দ করি, মাছ ধরি এটাই বড় বিষয়। তবে মাছ পালি মনের ভিতর আনন্দ বেশি ঠ্যাহে।”
আরেক মাছ শিকারি নাটোর থেকে আসা ওয়াসিম উদ্দিন (৪০) বলেন, “আমরা খুব হতাশ, বিলে আগের মতো মাছ নাই। প্রভাবশালীরা বিল দখলে রেখে চায়না জাল ও গ্যাস ট্যাবলেট ব্যবহার করে মাছ ধরে নেয়। পানি পচে মাছ, কীটপতঙ্গ সব মরে গেছে। প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো ও বিলগুলোতে বেশি পরিমাণে মাছ ছাড়ার দাবি জানান তিনি।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, “বাউত উৎসবের নামে মাছের প্রজনন ও জীববৈচিত্রের চরম ক্ষতি হয়। এদিকে সৌখিন মৎস্য শিকারিদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। আর মাছের উৎপাদন বাড়াতে জলা মৎস্য বিভাগ প্রতিবছরই বিলগুলোতে মাছের পোনা অবমুক্তকরণসহ নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। গ্যাস ট্যাবলেট বা অবৈধ জাল ব্যবহারের অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”