পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ২৭ তম বার্ষিকী আজ। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মধ্য দিয়ে- পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাতের অবসান ঘটে। আদিবাসীরা যাতে নিজেদের স্বতন্ত্র অধিকার এবং বৈষম্যের শিকার না হয়, সে লক্ষ্যে এই চুক্তি করা হয়েছিল। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের ২৭ বছর পরেও বাস্তবায়ন হয়নি সব ধারা এমনটি মনে করছেন পাহাড়ের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।
চলতি বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকার পার্বত্য শান্তি চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করবে এমনটাই আশা করছেন পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের নেতারা। এই চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে বলে মনে করছেন তারা।
এদিকে পার্বত্য অঞ্চল (বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি) ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে শান্তি চুক্তির ২৭ বছর পূর্তি উদযাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা কেএস মং।
ইউনাইটেড পিপল’স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (গণতান্ত্রিক) বান্দরবান জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক উবামং মারমা বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তির পক্ষে এবং বিপক্ষের ব্যক্তিদের মধ্যে সংঘাত, রক্তপাত ও হানাহানি কারণে পাহাড়ে অশান্তি বিরাজ করছে। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে আহ্বান- তারা যেন পার্বত্য চট্টগ্রাম যে চুক্তি ধারাগুলো বাস্তবায়ন হয়নি, তা দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করেন।”
বান্দরবান জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি সভাপতি ও মানবাধিকার কর্মী অংচমং মারমা বলেন, “প্রায় তিন দশক আগে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি চুক্তি হয়েছে। চুক্তির সব ধারা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। পুরোদমে চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পাহাড়ে সংঘাত ও হানাহানি হচ্ছে। এখানকার মানুষের শান্তি ফেরাতে পার্বত্য চুক্তির সব ধারা বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি ফিরবে বলে মনে করি।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান কাজী মজিবুব রহমান বলেন, “পার্বত্য চুক্তি হয়েছিল পাহাড়ে স্থায়ীভাবে শান্তির প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে। তবে, চুক্তির ২৭ বছরেও পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। বরং অশান্তি অনেক গুণ বেড়েছে। এখানে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি হয়েছে। জেএসএস, জেএসএস সংস্কার, মূল ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) ও কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টসহ (কেএনএফ) একাধিক সশস্ত্র গ্রুপের জন্ম হয়েছে। প্রতিনিয়ত চলছে অভৈধ অস্ত্রের মহড়া, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, গুম, খুন ও অপহরণ। এসব সন্ত্রাসী দলগুলোই আলাদা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র দাবি করছে।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক ও আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কেএস মং বলেন, “শান্তি চুক্তি কোনো একক দলীয় সরকারের সঙ্গে বা একক দলের সঙ্গে করা হয়নি। খন্দকার মোস্তাক ব্যতীত বঙ্গবন্ধু আমল থেকে পতিত শেখ হাসিনার সরকার পর্যন্ত ২৬ বার বৈঠক হয়েছে। বিএনপির আলমে কর্নেল অলির নেতৃত্বে মূল কমিটির সঙ্গে ছয়বার বৈঠক করা হয়েছে। এরশাদ আমলে সাতবার, রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে উপ-কমিটির সঙ্গে ছয়বার ও আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সাত বার বৈঠকের পর শান্তি চুক্তিতে উপনীত হয়েছে।”
তিনি আরো বলেন, “এই চুক্তি সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জনগণের পক্ষ থেকে অঙ্গিকার করেছে। স্বাধীন সার্বভৌমত্বের প্রতি অবিচল আনুগত্য, আস্থা ও বিশ্বাস বজায় থাকবে। এটা একটা জাতীয় চুক্তি, আঞ্চলিক চুক্তি নয়। পার্বত্য শান্তি চুক্তি পার্বত্য অঞ্চলের জন্য তো বটেই, গোটা বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক। এই চুক্তি মানবাধিকার দৃষ্টিতে দেখলে, শুধু মার্মা বা চাকমারা নয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ও বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চুক্তি। এখানে প্রথাগত অধিকার আছে, বংশপরম্পরায় বসবাসের অধিকার আছে, সামাজিক অধিকার আছে। এই চুক্তির মধ্যে পাহাড়িদের পাশাপাশি ব্রিটিশ আমল থেকে বসবাসরত অবহেলিত বাঙ্গালিদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।”
প্রবীণ শিক্ষক ক্যশৈপ্রু খোকা বলেন, “শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও চূড়ান্তরূপে তা পরিপূর্ণতা লাভ করেনি। বর্তমান সরকার, এলাকার জনগণ, রাজনীতিবিদ ও দেশের জনপ্রতিনিধিসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ চুক্তি বাস্তবায়ন করলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করি।”
প্রসঙ্গত, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একটি রাজনৈতিক সংগঠন। আদিবাসীদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৮০ এবং ৯০ দশকে পাহাড়ে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করেছিল তারা। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘ আলোচনা শেষে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শান্তি চুক্তি সই হয়।