“ব্যাটা মারা গেছে ২০ বছর, এখন আর বলে কী হবে? যারা ছাড়া পেয়েছে, তারা আবার কিছুদিন ঘুরুক-ফিরুক।” কথাগুলো বলছিলেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত মাহাবুব রশিদের মা হাসিনার খাতুন। মাহাবুব ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দেহরক্ষী।
রবিবার (১ ডিসেম্বর) ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বিচারিক আদালতের বিচার অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ডেথ রেফারেন্স নাকচ করে এবং আসামিদের আপিল মঞ্জুর করে এই রায় দেওয়া হয়। ফলে এই মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ দণ্ডিত সব আসামি খালাস পেলেন।
এদিন বিকেলে রায় নিয়ে জানতে চাইলে নিহত মাহাবুব রশিদের বাবা-মা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তবে জানালেন শঙ্কার কথা। বলেন, ‘‘কী বলতে কী বলে ফেলি, এ নিয়ে পড়তে হবে বিপদে। আগের সরকার যা করেছে, তার মত করেই করেছে। আর এ সরকার যা করছে, তাদের মত করে করছে। ছেলে হত্যার ২০ বছর পার হয়েছে, বিচার পাইনি। এখন আর কী হবে এ নিয়ে কথা বলে?’’
নিহত মাহাবুব রশিদের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসার ফুলবাড়ি গ্রামে। রবিবারের উচ্চ আদালতের রায়ের কথা মাহাবুবের বাবা হারুন অর রশিদ ও মা হাসিনা খাতুনকে কেউ জানায়নি।
৮৫ বছরের বৃদ্ধ হারুন অর রশিদ রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “আমাকে নিয়ে যেন মিথ্যা কথা বলা বা লেখা না হয়। আমি বলব এক রকম আর আপনারা লিখবেন অন্য রকম। আগের বিচার ‘সে’ এক রকম করেছে। এখন বিচার হয়েছে অন্য রকম। রায় নিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া, হ্যাঁ না কিছুই বলব না। বিচারের রায় দিয়ে আমার কিছু যায়-আসে না।’’ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় নিহতদের মধ্যে এ নেতার দেহরক্ষী সাবেক সেনা সদস্য মাহাবুবসহ দলটির নেতাকর্মীসহ ২৪ জন নিহত হন।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় করা মামলায় (হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা) ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ রায় দেন। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এ ছাড়া ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেন বিচারিক আদালত।
রায়ের পর ২০১৮ সালে বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলা দুটির নথিপত্র হাইকোর্টে এসে পৌঁছায়। এটি সংশ্লিষ্ট শাখায় ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। আইনজীবীরা বলেন, কোনো ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে। এটি ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের জেল আপিল, নিয়মিত আপিল ও বিবিধ আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। ডেথ রেফারেন্স এবং এসব আপিল ও আবেদনের ওপর সাধারণত একসঙ্গে শুনানি হয়ে থাকে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের আপিল ও জেল আপিলের ওপর হাইকোর্টে গত ৩১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা হয়। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনার তদন্তকে ভিন্ন খাতে নিতে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার নানা তৎপরতা চালায় বলে অভিযোগ ওঠে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির (হত্যা ও বিস্ফোরক) নতুনভাবে তদন্ত শুরু করে।
২০০৮ সালে ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এতে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। পরে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে মামলার অধিকতর তদন্ত হয়। এরপর তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।