সারা বাংলা

আজ ঠাকুরগাঁও পাক হানাদার মুক্ত দিবস

ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াই আর মুক্তিকামী জনগণের দুর্বার প্রতিরোধে একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিল। নভেম্বরের শেষ দিক থেকেই পিছু হটতে শুরু করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। তাদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে আজকের এই দিনে।

ঠাকুরগাঁও জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের ডেপুটি কমান্ড আব্দুল মান্নান বলেন, “ঠাকুরগাঁও তখন ছিল মহকুমা। বর্তমান ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় জেলার ১০টি থানা ছিল এই মহকুমার অন্তর্গত। ৩ ডিসেম্বর সকাল থেকেই ঠাকুরগাঁও শহরে মানুষ জড়ো হতে থাকে। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বের হয় আনন্দ মিছিল। জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের জনপদ। হাজার হাজার মানুষ  উদ্বেলিত কন্ঠে ‘জয়বাংলা’ বলতে বলতে মুক্ত শহরের রাস্তায় বের হয়ে আসে। এ সময় অনেকের হাতে ছিল প্রিয় স্বদেশের পতাকা।”

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতের পর সারা দেশের মতো ঠাকুরগাঁয়েও পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করে। নিরস্ত্র বাঙালির ওপর চালায় নির্যাতন। গ্রামে গ্রামে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠণে তারা মেতে ওঠে। একইসঙ্গে চলতে থাকে একের পর এক অগ্নিসংযোগ। এরপর ১৫ এপ্রিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর দখলে চলে যায় ঠাকুরগাঁও।

এরই মধ্যে সংগঠিত হতে থাকে ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিকামী মানুষ। তারা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন দুর্বার প্রতিরোধ। ঠাকুরগাঁও তখন ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। কমান্ডার ছিলেন বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার এম. খাদেমুল বাশার। এ সেক্টরে প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ২৯ নভেম্বর এই মহকুমার পঞ্চগড় থানা প্রথম শত্রুমুক্ত হয়। পঞ্চগড় হাতছাড়া হওয়ার পর পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। এরপর তারা শক্তি বৃদ্ধি করে সদলবলে প্রবেশ করে ঠাকুরগাঁয়ে।

২ ডিসেম্বর রাতে ঠাকুরগাঁয়ে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনপণ লড়াইয়ে সে রাতেই শত্রুবাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটে ২৫ মাইল নামক স্থানে অবস্থান নেয়। ৩ ডিসেম্বর ভোররাতে ঠাকুরগাঁও শহর শত্রুমুক্ত হয়।

জেলার শহর থেকে পল্লী অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত গণকবর আর বধ্যভূমি।

তবে ঠাকুরগাঁও জেলার অধিকাংশ গণকবর আর বধ্যভূমিগুলোর এখন বেহাল অবস্থা রয়েছে। অযত্ন আর অবহেলার মধ্যে পড়ে থাকা গণকবরগুলো দেখার কেউ নেই। অধিকাংশ গণকবর আর বধ্যভূমি এখন গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল মজিদ বলেন, “এই বধ্যভূমি ১৯৭১ সালে ২৩ এপ্রিল ১৮নং শুকানপুর ইউনিয়নে ২০০০ থেকে ২৫০০ লোককে পাকিস্তানী সৈন্যরা নিরিহভাবে হত্যা করে। আমাদের এই শুকানপুকুরী বধ্যভূমি সংরক্ষণ করার দাবি জানাচ্ছি।”

মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যক্ষদর্শী রাজাগাঁও ইউনিয়নের বিমলা রাণী বলেন, “পাকিস্তানি বাহিনী আগে খরিলুপের বাড়িত আইছিল। খরিলুপের বাড়ি থেকে আসিল হামার বাড়ি। হামরা সবাই দৌড়া দৌড়ি করে পালানো। কিন্তু হামাক সবাকে ধরে নিয়ে আসিল হামার বস্তির তামাক লোকলাকে ধরে নিয়ে আসিছিল। সবাকে লাইন করে মারিক ৩১ জন ছিল। হামাক লাইক করে দাড়ায় থুইল কাহার নাক, নাখ, কাহার লাগের গোস্তগেলা ছিড়ায় নিছে। ওই সময় মুই গর্বপতি ছিনু মিলিটারিলঅ বন্দুনটা দিয়ে মোর পেটটাত গুতা দিছে আর মুই কিছু কহিবা পারু না।”

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বদ্দুরুদোজা বদর বলেন, “দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে যারা এতোটুকু কুণ্ঠিত হয়নি, আজ সেই সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ পায়নি তাদের যথাযথ মর্যাদা।”