সারা বাংলা

প্রতিদিন ফাঁদ পেতে ধরছে হরিণ, নির্বিকার প্রশাসন

সুন্দরবন ও বরগুনার পাথরঘাটার হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে হরিণ শিকারি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই হরিণ বিচরণ করা এলাকায় ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করছে তারা। এ কারণে হরিণের সংখ্যা কমছে। বন বিভাগের যোগসাজশ ও প্রশাসনের উদাসীনতায় শিকারিরা শিকারে মেতেছে। 

পূর্ব সুন্দরবনের কটকা, করমজল, হিরণপয়েন্ট, কচিখালী, সুপতি, ঢাংমারী ও করমজল অভয়ারণ্য এলাকায় হরিণের বিচরণ সব থেকে বেশি। এ সব এলাকায় দিনের বেলা হরিণ শিকারের ফাঁদ পেতে রাখে শিকারিরা। সেই ফাঁদে রাতে হরিণ ধরা পড়ে। 

ফাঁদ পাতার কিছু ছবি প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। ছবিতে দেখা যায়, সুন্দরবনের হরিণ বিচরণ করা এলাকায় ফাঁদ পাতছে শিকারি চক্র। 

সুন্দরবন এলাকায় মাছ শিকার করা জেলে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘‘আমি বলেশ্বর ও সুন্দরবনের আশপাশে মাছ শিকার করি। ৫ বছর আগে এসব এলাকায় মাছ শিকারে গেলে প্রতিদিন হরিণের দেখা পেতাম। এখন হরিণের দেখা মেলা ভার।’’

এ সব এলাকায় মাছ শিকার করা জুয়েল, টুকু, আজাদসহ একাধিক জেলে বলেন, ‘‘আগে মাছ শিকারে আসলে হরিণ দেখতাম। এখন আর হরিণ দেখি না বললেই চলে।’’  

জেলেরা বলেন, শিকারিরা প্রতিদিন ফাঁদ নিয়ে সুন্দরবন আসে। হরিণ শিকার করে আবার চলেও যায়। বন বিভাগ, কোস্টগার্ড কেউ নজর রাখে না। 

পাথরঘাটার হরিণঘাটা এলাকার বাসিন্দা কালু মিয়া বলেন, কয়েকটি চক্র হরিণ শিকার করছে। সুন্দরবনের নিরাপত্তা না থাকায় এখন হরিণ শিকার চক্র বেড়েছে।

একইভাবে বরগুনার পাথরঘাটার হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে শিকারিরা। স্থানীয়রা বলছেন, সুন্দরবন ও হরিণঘাটায় আগের মতো হরিণের দেখা মেলে না। 

বলেশ্বর নদীর ওপারে সুন্দরবন আর এপাড়ে পাথরঘাটার হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এ বনেও অসংখ্য হরিণ ছিল। এখন আর হরিণের দেখা পাওয়া কঠিন। 

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দারা বলেন, এ এলাকায় নতুন জামাতা আসলে হরিণের মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। হরিণ শিকার এতটাই বেড়েছে যে এখন হরিণঘাটায় হরিণ আদৌ আছে কি-না সেটাই সন্দেহ। যদি অল্প পরিমাণ থেকেও থাকে তাহলে সেসব হরিণ এখন আর শিকারি আতঙ্কে বিচরণ করে না।

বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করা সংগঠনের নেতারা বলছেন, বন বিভাগ ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে শিকারিা হরিণ শিকার করছে। 

বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা বাঘ বন্ধু নামে আখ্যায়িত পাথরঘাটার ইমাম হোসেন নাহিদ রাইজিংবিডিকে বলেন, হরিণ শিকারিদের থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বন বিভাগ ও প্রশাসন নিশ্চুপ। তারা হরিণের নয়, শিকারিদের নিরাপত্তা দিচ্ছে। বলেশ্বর নদীতে কোস্টগার্ডের টহল না থাকায় সুন্দরবন থেকে হরিণ শিকার করে শিকারিরা নিরাপদ রুট হিসেবে বলেশ্বর নদী পার হয়ে পাথরঘাটায় ঢুকছে। এরপর পাথরঘাটা থেকে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় হরিণের মাংস বিক্রি করে থাকে চক্রটি। বন বিভাগ ও প্রশাসন সবাই সবকিছু জানে কিন্তু টাকা নিয়ে তারা সবাই ম্যানেজ। 

তিনি বলেন, প্রশাসন চাইলে একটি হরিণ শিকার হবে না, আবার প্রশাসন না চাইলে সুন্দরবনে কোনো হরিণ থাকবে না। তবে এখন যে হারে হরিণ শিকার হচ্ছে, তাতে মনে হয় হরিণ থাকুক এটা কেউ চায় না। 

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে দেখি কোস্টগার্ড হরিণের চামড়া, মাথা, শিং এসব উদ্ধার করেছে কিন্তু হরিণের মাংস উদ্ধার হয় না। এর কারণ হচ্ছে মাংস ভাগ-বাটোয়ারা করে খেয়ে ফেলে। এসব ঘটনায় কেউ আটকও হয় না। 

পাথরঘাটার প্রবীণ সাংবাদিক মির্জা খালেদ রাইজিংবিডিকে বলেন, যে হারে হরিণ শিকার বেড়েছে, তাতে মনে হয় না আর খুব বেশি সময় হরিণ সুন্দরবন ও পাথরঘাটার হরিণঘাটা সংরক্ষিত বন অঞ্চলে থাকবে না। বন বিভাগ ও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় পাথরঘাটা উপজেলা হরিণ শিকারিরা নিরাপদ এলাকা হিসেবে ব্যবহার করছে। হরিণ শিকার বন্ধ করা না গেলে সুন্দরবন ইকো সিস্টেম হারাবে।  

এ বিষয়ে কথা বলতে পাথরঘাটা বন বিভাগে একাধিকবার গিয়েও কেউকে পাওয়া যায়নি। তবে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হোসেন রাইজিংবিডিকে বলেন, সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে হরিণ রক্ষায় কাজ করছে পুলিশ। পাথরঘাটা উপজেলা কোননো অপরাধের নিরাপদ এলাকা হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। হরিণ রক্ষায় স্থানীয়ভাবে তথ্য সংগ্রহ করে শিকারি চক্রের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

গত পাঁচ বছরে শুধু পাথরঘাটা থানায় হরিণ শিকার নিয়ে ২৪টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি মামলা ফাঁদ উদ্ধারের। অথচ সেসব মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই।