সারা বাংলা

‘‘চোখ বন্ধ করলেও রাহিমের চেহারা ভেসে ওঠে, খুললেও ওকে দেখি’’

গণঅভ্যুত্থানে নিহত আবু রায়হান রাহিমের শোক কাটিয়ে এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি রওশন আরা বেগম। এই মায়ের পক্ষে তা হয়তো আর কখনও সম্ভব হবে না। সন্তানকে এখনও প্রতিনিয়ত খুঁজে ফিরছেন তিনি।  

আবু রায়হান যেখানে জুতা রাখতেন, মনের অজান্তেই সেখানে গিয়ে রওশন আরা দেখছেন, ছেলের জুতাজোড়া ঠিক আছে কিনা। যে সময় রায়হান বাসায় ফিরতেন, সে সময় মোটরসাইকেলের শব্দ শুনলেই বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করে উঠছে। মায়ের মন বলছে, এই বুঝি ছেলে দরজায় করা নাড়বে! বাড়িতে ঢুকেই জানতে চাইবে- ‘মা ভাত খেয়েছেন?’

রওশন আরা যখন কথাগুলো বলছিলেন তখনও তার দুচোখে ছিল শূন্যতা। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে ছিল ছেলের জন্য আকুতি।   

আবু রায়হান রাহিম বগুড়ার দুপচাঁচিয়া পৌর শহরের চকসুখানগাড়ী মহল্লার মৃত শাহজাহান আলীর ছেলে। তিনি উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। গত ৪ আগস্ট সরকার পতনের আন্দোলনে গিয়ে দুপচাঁচিয়া থানার সামনে দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ হন রাহিম। এরপর তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়ার পর সেখান থেকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে ওই দিনই তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। ৫ দিন ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক (পঙ্গু) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ৯ আগস্ট তিনি মারা যান। 

ছেলের মৃত্যুর পর রওশন আরা বেগম বাদী হয়ে গত ১৭ আগস্ট ২২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৮২ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।

রওশন আরা বেগম জানান, ছেলের জন্য প্রতিরাতেই তার ঘুমে ভেঙে যায়। ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “একবার এক ঘটনায় রাহিমের উপর রাগ করেছিলাম। ভাত না খেয়ে ছিলাম। রাহিম আমার দুই পা মাথায় নিয়ে বলেছিল, ‘এটাই আমার জান্নাত, এটাই আমার স্বর্গ, এটাই আমার সব। ও মা তুমি একগ্রাস ভাত খাও মা।’ এরপর রাহিম আমাকে ভাত তুলে খাইয়েছিল।” 

এই স্মৃতিই সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে জানিয়ে রওশন আরা বলেন, ‘‘এই স্মৃতি ভুলতে পারছি না। চোখ বন্ধ করলেও রাহিমের চেহারা ভেসে ওঠে, চোখ খুললেও রাহিমের চেহারা দেখতে পাই। রাতে এখনও কেউ যদি বাড়ির পাশ দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে যায়, হর্ন বাজায়, বুকের ভেতর হুহু করে। মনে হয় দৌড়ে চলে যাই। এই বুঝি রাহিম এলো!’’

ছেলের ছবি হাতে কাঁদছেন মা

“৪ আগস্ট সকাল থেকেই বাইরে অনেক মানুষ আন্দোলনে যাচ্ছিল। অনেক ছোট ছোট ছেলেও ছিল। অনেকেই বাসায় এসে পানি খেতে চাচ্ছিল। আমি তাদের পানি খাওয়াচ্ছিলাম। এর মধ্যে আমি রাহিমকে বলি ‘বাবা তুমি আজকে যেন ওদিকে যেও না।’। সে বলেছিল, ‘না মা আমি যাবো।’ এরপর আমি বাড়ির অন্য কাজ করছিলাম। পরে বাড়ির বাইরে বের হতেই একজন আমাকে জানায় রাহিম আবারও আন্দোলনে গেছে।’’

‘‘আমি রাহিমকে খুঁজছিলাম, তখন একজন আমাকে বলে- ওর গুলি লেগেছে। তার কথামতো দুপচাঁচিয়া হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার ছেলেকে বেডে শুইয়ে রেখেছে। ওর পায়ের নিচে যে চাদর ছিল, সেই চাদর রক্তে ভিজে চপচপে হয়ে আছে। আমাকে দেখেই রাহিম বলে উঠল, ‘মা, মা, আমি হয়তো আর বাঁচবো না মা!’’

কথাগুলো বলেই মুখে আঁচলচাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন মমতাময়ী এই মা। নিজেকে সামলে নিতে সময় নেন। কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘‘পরে ওই হাসপাতালের ডাক্তাররা আমাদের জানালো এখানে চিকিৎসা হবে না, মেডিকেলে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কোনো গাড়ি পাচ্ছিলাম না। অটোরিকশাওয়ালা ডাকলে সেও গাড়ি যদি ভাঙে এই ভয়ে যেতে চাচ্ছিল না। পরে একজন রাহিমের অবস্থা দেখে ঝুঁকি নিয়ে যেতে রাজি হয়। এ সময় আমি আর রাহিমের স্ত্রী দুই মেয়ে মানুষ ছাড়া আমাদের সঙ্গে আর কেউ ছিল না।’’

‘‘মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তাররা ঢাকায় নিয়ে যেতে বলে। ঢাকা যাওয়ার জন্যও গাড়ি পাচ্ছিলাম না। এদিকে আমার ছেলে যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল! ছটফট করছিল! পরে একজন ড্রাইভার ৩০ হাজার টাকা ভাড়া দাবি করলে আমি তাতেই রাজি হয়ে ছেলেকে ঢাকায় নিয়ে যাই। প্রথমে তাকে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তারা সেখান থেকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে পাঠায়। সেখানেই ওর পায়ে অপারেশন করা হয়। তারপরও রাহিমের পায়ের যন্ত্রণা কমছিল না। ও আমাকে বারবার বলছিল, ‘মা অপারেশন তো হয়ে গেলো, এর পরেও কেন আমার পায়ের যন্ত্রণা কমছে না?’’ 

‘‘মা হয়ে আমি ছেলের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারিনি। ডাক্তারদের কাছে দৌড়িয়েছি। কেউ আমার ছেলের যন্ত্রণা কমাতে পারেনি।’’ রওশন আরা বেগমের বুকফাটা আর্তনাদে পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। এর পরের ঘটনা আরো মর্মভেদী। আবু রায়হানের অবস্থা সংটাপন্ন হতে শুরু করে। তাকে ৯ তারিখ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে নেওয়া হয়। সেখানেই সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মারা যান তিনি।

রাহিমের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার বলেন, “যে দুনিয়া এবং আখিরাতের সঙ্গী, সে ছাড়া কীভাবে থাকা যায়? আর্থিকভাবে আল্লাহ যেভাবে চালাচ্ছে, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমার স্বামী যে নাই, এই অভাব কি টাকা-পয়সা কোনো কিছু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব! যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে আজীবন থেকে যাবে।’’

স্বামী-সন্তান নিয়ে সুন্দর জীবন যাপনের স্বপ্ন সবাই দেখেন। এই স্বপ্ন দিলরুবা আক্তারেরও ছিল। কিন্তু তার ভাগ্য সহায় হলো না।

দিলরুবা বলেন, ‘‘স্বৈরশাসকের কারণেই এটা হলো। তা না হলে হয়তো সে আরো কিছুদিন বাঁচতো। আমাদের সঙ্গে থাকতো! উনি শহীদ হয়েছেন। এখন একটাই চাওয়া আল্লাহ তাকে ভালো জায়গায় রাখুক। শান্তিতে রাখুক। কবরটাকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দিক।”