সারা বাংলা

আবু সাঈদের মতো বুক পেতে দেন সজল

দিনটি ছিলো ৪ আগস্ট। সরকার পতনের এক দফার লড়াই। সকাল ১০টার দিকে শহরের থানারপুল চত্বর থেকে পিটিআই মোড় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে চলছে সংঘর্ষ, গুলিবর্ষণ আর ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ। সেদিন রংপুরের আবু সাঈদের মতোই দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দেন দিনমজুর সজল মোল্লাও। বুকে ও পেটে এসে লাগে বেশ কয়েকটি গুলি। মুহূর্তে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। 

সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন দিনমজুর রিয়াজুল ও ডিজলসহ আরো বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী। এরমধ্যে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে গুলিবিদ্ধ রিয়াজুল ও ডিপজলকে মৃত ঘোষণা করেন সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক। আর গুলিবিদ্ধ সজলকে জেলার সিরাজদীখান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে মৃত ঘোষণা করেন সেখানকার জরুরী বিভাগের চিকিৎসক। সামান্য দিনমজুর থেকে মুন্সীগঞ্জ শহরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে নিহত ডিপজল, সজল ও রিয়াজুল আজ হয়ে উঠেছে রক্তে লেখা নাম। এদের সবার বাড়ি শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকায়। 

রিয়াজুল ফরাজীর ৪ জনের টানাটানির সংসার। তাই তো জীবন জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন ছুটতেন স্যানিটারির কাছে। যা পেতেন তা-দিয়েই চলতো পরিবারের খরচ। হাতে কাজ না থাকলে বের হতেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে। আর সংসারের আয় রোজগারে ব্যাটারি চালিত মিশুক চালানোর পাশাপাশি রং-মিস্ত্রির কাজ বেছে নিয়েছিলো সজল মোল্লা (৩০)। এছাড়া মিশুক চালিয়ে নানীর হাতে প্রতিদিনের রোজগারের টাকা তুলে দিতেন নুর মোহাম্মদ ওরফে ডিপজল সরদার (১৯)। এভাবেই চলত তিন দিনমজুরের সংসার। সরকার পতনের আন্দোলনে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন তারা। 

রিয়াজুল ফরাজী শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকার প্রয়াত কাজী মতিন ফরাজীর ছেলে। ২ মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। এদের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ধারদেনা করে। ছোট মেয়ে পড়ছে দশম শ্রেণিতে। একমাত্র উপার্জনক্ষম রিয়াজুলের চলে যাওয়া কোনো মতেই মেনে নিতে পারছেন না স্ত্রী-মেয়েরা। বাবার কথা যখনই মনে পড়ে, তখনই কেঁদে উঠে মেয়ে খুকু আক্তার। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই কারোই। 

মেয়ে খুকু আক্তার বলেন, “আমার বাবা ছিলেন খেটে খাওয়া একজন মানুষ। স্যানিটারি পাইপ ফিটিংয়ের কাজ করতেন। হাতে কাজ না থাকলে অটোরিকশা চালাতেন। সেদিন আন্দোলনে গোলাগুলিতে আমার বাবা গুলিবিদ্ধ হলে স্থানীয়রা হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে শুনতে পারি বাবা মারা গেছেন।” 

বিলাপ করতে করতে রিয়াজুলের স্ত্রী রুমা আক্তার বলেন, “তোমারে বাইরে যাইতে মানা করছিলাম। তখন বলেছিলা জলদি ফিরা আইবা। তুমিতো আর ফিরা আইলা না। আমরা কই যামু, কি করমু, কে আমাগো দেখবো।”

অন্যদিকে, উত্তর ইসলামপুর এলাকার আলী আকবর মোল্লার দুই ছেলে সজল মোল্লা ও সাইফুল মোল্লা অংশ নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। দুই ভাই-ই ছিলেন অগ্রভাগে। দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দেয় বড় ভাই সজল। আর তখনই ছোট ভাই সাইফুলের চোখের সামনেই বুকে আর পেটে গুলিবিদ্ধ হন বড় ভাই। ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।

 রিয়াজুল ফরাজী ও  নুর মোহাম্মদ ওরফে ডিপজল সরদার।

ভাই সাইফুল মোল্লা বলেন, “বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ই সজল বলে গিয়েছিলো সরকার পতন করে লাল সবুজের পতাকা হাতে নিয়েই বাড়ি ফিরবে। নয়তো শহীদ হয়ে ফিরবে। আমার ভাই সরকার পতন দেখে যেতে পারেনি। তবে তার কথা রেখেছে। লাশ হয়ে বীরের বেশে বাড়িতে ফিরেছেন।” 

ছেলেকে হারানোর বেদনায় মুষড়ে আছেন বাবা আলী আকবর মোল্লা। ছেলে সজলের কথা জানতে চাইতেই চোখ ছলছল করে উঠেন। তিনি বলেন, “হোক দুনিয়ায়, নয় তো পরকালে হলেও ছেলে হত্যার বিচার চাই।” 

নিহত নুর মোহাম্মদ ওরফে ডিপজল সরদার শরীয়তপুর জেলার নড়িয়ার সিরাজুল সরদারের ছেলে। ডিপজলের জন্মের আগেই মা-বাবা চলে আসেন মুন্সীগঞ্জ শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকায়। বসবাস শুরু করেন ভাড়া বাসায়। কিছুদিন পরই বাবা সিরাজুল চলে যান শরীয়তপুরের নড়িয়া ও মা রুমা খাতুন গৃহপরিচারিকার কাজ নিয়ে চলে যান ঢাকায়। উত্তর ইসলামপুর এলাকার নানী সেফালীর কাছে বড় হতে থাকে ডিপজলের দুই ভাই ও দুই বোন। নানীর সংসার চালাতে বেছে নেয় মিশুক চালানোর কাজ। 

ডিপজলের মা রুমা খাতুন বলেন, “মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে ফোন কইরা পোলাডা কইছিলো মাগো তোমারে আর ঢাকা থাকতে লাগবো না। খুব তারাতারি লইয়া আইবো। যত ধারদেনা আছে সব কাজ কইরা শোধ করবো। সবাইরে লইয়া এক সাথে এক বাড়িতে থাকবো। আমার পোলাডার সঙ্গে থাকা অইলো না। গুলি কাইর‌্যা নিলো পোলাডারে।” 

মুন্সীগঞ্জ শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকার পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সীলর ও সাবেক জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হাসান তুষার বলেন, “গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলিতে আমার এলাকার মোট তিনজন শহীদ হয়েছেন। যারা শহীদ হয়েছেন তারা সবারই পরিবার খুবই দরিদ্র ও অসহায়।” 

তিনি বলেন, “রিয়াজুল ফরাজি দিনমজুর ছিলেন। সংসার চালাতে গিয়ে যখন যে কাজই পেতেন তাই করতেন। এছাড়া সজল মোল্লার বাবা অনেক অসুস্থ থাকার কারনে সংসারের বোঝা তার কাঁধে পরে। রং-মিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাতেন সজল। এছাড়া নুর মোহাম্মদ ওরফে ডিপজল সরদার শরীয়তপুর জেলার নড়িয়ায় হলেও দু’মুঠো ভাতের আশায় ছোট বেলায়ই চলে আসেন মুন্সীগঞ্জ শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকায়। নানীর সাথে থেকে সংসার চালাতে বেছে নেয় মিশুক চালানোর কাজ।”

তিনি আরো বলেন, “আমাদের উত্তর ইসলামপুরবাসী, জেলা বিএনপি ও বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে যতটুকু সাহায্য সহযোগীতা পরিবারগুলো পাচ্ছে তাতে কোনো রকম অসহায় পরিবারগুলোর দিন কাটছে। এ এলাকার সবার দাবি, বর্তমান সরকার যদি এ তিনটি পরিবারকে ধারাবাহিকভাবে বা স্থায়ীভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে পুনর্বাসন করেন তাহলে পরিবার তিনটি বেঁচে যাবেন।”

প্রসঙ্গত, সজল মোল্লা নিহতের ঘটনায় তার ছোট ভাই সাইফুল মোল্লা গত ২০ সেপ্টেম্বর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও তার ছেলে মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফয়সাল বিপ্লবসহ ৪৫১ জনকে আসামি করে মুন্সীগঞ্জ সদরে হত্যা মামলা করেন। এর আগে ২০ আগস্ট রিয়াজুল ফরাজীর স্ত্রী রুমা আক্তার ও ৩০ আগস্ট নুর মোহাম্মদ ওরফে ডিপজলের নানী শেফালি বেগম একই থানায় হত্যা মামলা করেন।