চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে সারবাহী জাহাজে হামলা চালিয়ে সাত জনকে হত্যার উদ্দেশ ডাকাতি নয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ঘটনার পেছনে অন্য রহস্য আছে বলে তারা ধারণা করছেন।
পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে কাজ শুরু করেছে পুলিশ, নৌ-পুলিশ, কোস্টগার্ড, সিআইডি ও প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। ধারণা করা হচ্ছে, নৌপথে অস্থিরতা তৈরি করতেই এ হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটানো হয়েছে।
নৌ-পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, “৮ জন নয়, সেখানে আমরা ৯ জন থাকার খবর পাচ্ছি। এরই মধ্যে আমাদের কাছে আরো নানা তথ্য আসছে। এটা প্রথম দিকে ডাকাতি মনে হলেও এখন এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ধরেই আমরা এগুচ্ছি। নৌপথে অস্থিরতা তৈরি করতেই এমনটি করা হয়েছে কিনা খতিয়ে দেখছি। সকাল ১১টার দিকে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার কথা রয়েছে। এরপরই লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হবে।”
এর আগে চাঁদপুরের হরিণা ফেরিঘাটের পশ্চিমে মেঘনা নদীর পাড়ে মাঝিরচর এলাকায় একটি জাহাজ থেকে সোমবার বিকেল ৩টার দিকে পাঁচজনের মরদেহ এবং তিনজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে আরও ২ জন মারা যান।
নিহতদের মধ্যে নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার লহরিয়া কালিগঞ্জের এগারনলি গ্রামের বাসিন্দা আবেদ মোল্লার ছেলে মো. সালাউদ্দিন (৪০), একই জেলার ইটনা ইউনিয়নের পাংখার চর উত্তর গ্রামের মাহবুব রহমান মুন্সির ছেলে আমিনুর মুন্সি (৪১), ফরিদপুর জেলার কোতয়ালী উপজেলার ১১নং গেদ্দা ইউনিয়নের জুয়াইর গ্রামের বাসিন্দা আনিছুর রহমানের ছেলে মো. কিবরিয়া (৬৫), একই জেলার মৃত আতাউর রহমানের ছেলে শেখ সবুজ (২৭), রানার বাড়িও ফরিদপুরে, মাগুড়া জেলার মোহাম্মদপুর উপজেলার মন্ডল গাতি পোষ্ট অফিসের চর বসন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা আনিছ মিয়ার ছেলে মো. মাজেদুর (১৮) ও একই জেলার পলাশ বাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা দাউদ হোসেনের ছেলে মো. সজিবুল ইসলাম (২৯)।
গুরুতর অবস্থায় প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রাতে অ্যাম্বুলেন্সে করে জুয়েল রানা (২৩) নামে এক সুকানিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তার শ্বাসনালী কেটে গেছে।
এমন লোমহর্ষক ঘটনা দেখে বিস্মিত চাঁদপুরবাসী। তারা এ ঘটনার রহস্য উন্মোচনসহ দ্রুত জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
এদিকে জাহাজটি নোঙ্গর করা অবস্থায় ছিলো না বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তারা জানান, এটি স্রোতের টানে ঈশানবালা ঘাটের দিকে আটকে ছিলো।
বিভিন্ন জাহাজের সংশ্লিষ্টদের বরাত দিকে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এমভি আল-বাখেরা জাহাজের মালিক একাধিক ব্যক্তি। মাষ্টার নিয়োগসহ লেনদেনে দ্বন্দ্ব থেকেও এ হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটানো হতে পারে।
এদিকে এমভি আল-বাকেরা জাহাজে সাতজন ক্রু সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কর্মবিরতির হুঁশিয়ারি দিয়েছে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন। আগামী ২৬ ডিসেম্বরের মধ্যে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা না হলে কর্মবিরতিতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় গণমাধ্যম কর্মীদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুর রহিম। তিনি বলেন, “আমরা সবাই মিলে আলোচনায় বসেছি। এভাবে অনিরাপদভাবে কার্গো জাহাজ চলাচল করতে পারে না। আমরা আমাদের জীবনের নিরাপত্তা চাই। তাই অচিরেই আমরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের মতো কর্মসূচি হাতে নিতে যাচ্ছি।”
চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, “আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। নিরাপত্তা নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়েছে। এখন থেকে নিরাপত্তা বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কাজ শুরু করেছি। আশা করছি এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য দ্রুত উন্মোচিত হবে।”
এদিকে এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ঘটনার রহস্য উন্মোচনে ছায়া তদন্তে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম। ইতিমধ্যেই ওই জাহাজ থেকে রক্তমাখা চাইনিজ কুড়াল উদ্ধার করেছে নৌ-পুলিশ।
নৌ-পুলিশের চাঁদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার কার্যালয়ের উপ-পরিদর্শক শেখ আব্দুস সবুর বলেন, “প্রথমে জাহাজে ৮ জন থাকার কথা জানলেও পরে ৯ জন থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। এখন যিনি সুস্থ আছেন তিনিই ভালো বলতে পারবেন বাকি যে ব্যক্তি তার পরিচয়। এটি ডাকাতির ঘটনা মনে হয়নি। জাহাজে প্রায় ২ কোটি টাকার সার ছিলো, যার কিছুই লুট হয়নি। এছাড়া জাহাজেরও কোন ক্ষতি হয়নি। তাই এটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে ধারণা করা হচ্ছে।”
এ সময় এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “নোঙ্গর অবস্থায় জাহাজটি পাওয়ার বিষয়টি এখনো আমরা নিশ্চিত নই। আবার যাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে তাকে ঘিরেও কোনো নাটকীয়তা আছে কিনা তাও তদন্তের বিষয়। মালিক পক্ষের কোনো ঝামেলা থেকে এ ঘটনা কিনা তাও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “ধারণা করছি রবিবার রাত ১টা থেকে ২টার মধ্যে ঘটনাটি ঘটেছে। আমরা সোমবার দুপুর ২টার দিকে খবর পেয়েছি। এটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। প্রত্যেকের মাথায় গুরুতর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। জাহাজের পাঁচটি কক্ষে পাঁচ জনের লাশ পেয়েছি আমরা। আরও তিন জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় পেয়েছি। পরে তাদের উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে দুজনের মৃত্যু হয়। আটজনই জাহাজটিতে ছিলেন। ধারণা করছি, ঘুমন্ত অবস্থায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলায় ও মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে।”
এদিকে জাহাজটির একাধিক মালিকানার তথ্য নিশ্চিত করেছেন এর অন্যতম মালিক মাহবুব মোর্শেদ। তিনি বলেন, “আমরা ৬ জন এই জাহাজটির মালিকানায় রয়েছি। তবে আমাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। তাছাড়া মাষ্টার ও একজন স্টাফ ছাড়া আমরা কাউকেই নিয়োগ দেই না। এগুলো নিয়ে মাথাও ঘামাই না আমরা। জাহাজে কতজন কাজ করবে সেটা মাষ্টারই ঠিক করেন। জাহাজটিতে ৮ জন নাকি ৯ জন ছিলো তা আমি বা আমরা কেউই নিশ্চিত নই। আমরাও চাই এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য দ্রুত জানা যাক।
এর আগে রবিবার (২২ ডিসেম্বর) সকাল ৮টায় সারবোজাই করে চট্টগ্রামের কাপ্পো জেটি হতে মেসার্স বৃষ্টি এন্টার প্রাইজের আল-বাখেরাহ জাহাজটি সিরাজগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়। পরে চাঁদপুরের হাইমচরের গাজীপুর ইউনিয়নের ঈশানবালা ও মাঝের চর এলাকার মাঝামাঝি মেঘনা নদীতে জাহাজটি দেখে অন্য জাহাজের লোকজন এগিয়ে আসে। পরে পাঁচজনের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে পুলিশকে খবর দিলে ঘটনাস্থলে প্রশাসন পৌঁছলে সেখানে পাঁচজনকে মৃত অবস্থায় দেখেন। এরপর জাহাজটির বিভিন্ন ডেকে আরও তিনজনকে রক্তাক্ত মুমূর্ষু অবস্থায় পেয়ে হাসপাতালে পাঠালে চিকিৎসক দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন এবং একজনকে ঢাকা প্রেরণ করেন।