বাঙালির ইতিহাসে নলেন গুড়ের বন্দনা নতুন নয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে শ্রীধর দাস তার সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ বলেছিলেন নতুন গুড়ের তথা নলেন গুড়ের কথা। নীহাররঞ্জন রায় ‘বাঙালীর ইতিহাস, আদি পর্ব’ গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন এই গুড়ের কথা। খেজুরের গাছ থেকে সংগৃহীত রস দিয়ে তৈরি নলেন গুড় শত শত বছর ধরে বহন করে চলেছে তার ঐতিহ্য। আর এই গুড়, খাঁটি দুধের ছানা এবং চিনির সংমিশ্রণে নড়াইলে তৈরি হয় নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ। যা এখন দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও যাচ্ছে।
নড়াইল সদরের রূপগঞ্জ বাজারে রয়েছে ‘কার্তিক কুন্ডু মিষ্টান্ন ভান্ডার’। তারা ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে তৈরি করছে নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ। নলেন গুড়ের ক্ষীরের সন্দেশ, ক্ষীরের চমচম তৈরি করে তারা। পাশাপাশি কালোজামসহ বিভিন্ন স্বাদের মিষ্টি তৈরি হয় এই দোকানে।
জেলার লোহাগড়া উপজেলার লক্ষীপাশা পুরাতন খেয়াঘাট সংলগ্ন ‘সাহ সুইটস’ এবং লোহাগড়া বাজারের ‘সুরেন্দ্র সুইটস’সহ জেলার আরো কয়েকটি মিষ্টির দোকানে এখন দেদারসে বিক্রি হচ্ছে নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ। শীতের শুরুতেই কদর বাড়ে এর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীরা অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়ে নিজেদের সঙ্গে নলেন গুড়ের সন্দেশ নিয়ে যান। স্বজনরাও প্রবাসীদের জন্য এই সন্দেশ পাঠিয়ে থাকেন।
মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) সকালে লোহাগড়া বাজারে সুরেন্দ্র সুইটস মিষ্টি দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিকেজি নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় বিয়ে, নববর্ষসহ বিভিন্ন উৎসবে এই মিষ্টির দেখা মেলে। বাড়িতে বন্ধু-আত্মীয়রা এলে এই মিষ্টি দিয়ে তাদের আপ্যায়ণ করা হয়। নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশের স্বাদ নিতে নড়াইলের আশপাশের জেলা থেকেও মানুষরা আসেন।
নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ কিনতে আসা আনিসুজ্জামান জানান, তার বোনদের পরিবার থাকে আমেরিকায়। তাদের কাছে পাঠানোর জন্য এ মিষ্টি কিনতে এসেছেন। গুণগত মান ভালো হওয়ায় এ মিষ্টি খেয়ে তৃপ্তি পান তারা। মাঝে মধ্যেই তারা এই মিষ্টি পাঠাতে বলেন।
সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা কাজী শওকত আলী বলেন, “পরিবারের সদস্যদের জন্য নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ কিনতে এসেছি। ছোটবেলা থেকেই লোহাগড়া বাজারের নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ খাচ্ছি।”
সাহা সুইটসের স্বত্বাধিকারী অভিজিৎ সাহা বলেন, “বংশ পরম্পরায় ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছি আমরা। আমার ঠাকুর দাদা সচিন্দ্রনাথ সাহা নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ তৈরি করে বিক্রি করতেন। বাজারে প্রচুর চাহিদা ও সুনাম থাকায় ঠাকুর দাদার মৃত্যুর পর দাদি নমিতা রাণী সাহা হাল ধরেন।”
তিনি আরো বলেন, “নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ তৈরি ও বিক্রি আমাদেরও পৈত্রিক ঐতিহ্য বহন করে। অতুলনীয় স্বাদ ও গুণগত মানের কারণে এই মিষ্টি ধরে রেখেছে তার ঐতিহ্য। দীর্ঘ সময়েও ভাটা পড়েনি চাহিদায়। এখন এলাকার চাহিদা মিটিয়ে এই মিষ্টি যাচ্ছে বিদেশেও।”