পাঠকের আড়ালে থাকা রহস্যময় একজন লেখক ওবায়েদ হক। তিনি তাঁর লেখাগুলোকে নিজের সন্তান মনে করেন। আর সন্তানের পিতা হিসেবেই তিনি পরিচিত হতে চান। ছোট একটি বইকে বিস্তৃত না করে কীভাবে কাহিনীগুলোকে এক সুতোয় বাঁধা যায়, তার প্রমাণ তাঁর বইগুলো। সহজ ও সাবলীলভাবে তাঁর জীবন দর্শনকে লেখায় ফুটিয়ে তোলেন মোহনীয় রূপে।
এ পর্যন্ত লেখকের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচটি। তার মধ্যে উপন্যাস তিনটি-জলেশ্বরী, তেইল্যা চোরা, এবং নীল পাহাড়। আর দুটি গল্পগ্রন্থ-একটি শাড়ি ও কামড়াঙা বোমা, এবং নেপথ্যে নিমকহারাম। অচেনা অজানা এই লেখককে নিয়ে ব্যাপক আলোচনার ফলস্বরূপ তাঁর বই পড়ার প্রতি চরম আকর্ষণ বোধ করি। তারপরই একটানা তাঁর তিনটি উপন্যাস পড়ে ফেলি। অসাধারণ বই জলেশ্বরীতে ফুটে উঠেছে আটাশি সালের বন্যার ভয়াবহ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি আর মানুষের দুর্ভোগ। তবে দারুণ বর্ণনাধর্মী এই লেখায় শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পাঠকের উত্তেজনা ধরে রাখতে পেরেছেন লেখক অদ্ভুত এক রহস্যের মাধ্যমে।
ওবায়েদ হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘তেইল্যা চোরা’। এখানে চিত্রিত হয়েছে এক চোরের মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত হওয়ার গল্প। এই বইটিতে মানুষের মনুষ্যত্বের সংকোচন সম্প্রসারণ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ব্যাপক আকারে দেখানো হয়েছে।
লেখকের সবচেয়ে বেশি যে বইটি মনে দাগ কেটে আছে তা ‘নীল পাহাড়’। এই বইতে ওবায়েদ হক দারুণভাবে পাহাড়ের চরম অবস্থার চিত্র এঁকেছেন। পাহাড়ি বাঙালি বিবাদ, প্রায় প্রতিনিয়ত ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, মাথাচাড়া দিয়ে উঠা বিভিন্ন উগ্র পাহাড়ি সংগঠন, একই সাথে প্রেম-ভালোবাসা-মায়া-দয়া, হিংস্রতা এবং ঘৃণার উপস্থিতি সত্যিই মুগ্ধ করার মতো। আর সবশেষে নীল পাহাড়ের রহস্য উদঘাটন এখনও ভাবায়।
একটি বিষয় লক্ষ করার মতো- ওবায়েদ হক তাঁর তিনটি উপন্যাসেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেছেন। তিনি চাইলে অনায়াসে তাঁর উপন্যাসগুলোকে আরো বিস্তৃত করতে পারতেন। তবে তাতে হয়ত পাঠকের আকর্ষণ কিঞ্চিৎ ক্ষুন্ন হতো! লেখকের বাক্যগুলো সব ভাবনার যোগ্য, বাক্য গঠন ক্ষুদ্র, কিন্তু রসবোধ আর রহস্যময়তার প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ স্পষ্ট।
একটি সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে ওবায়েদ হক বলেছিলেন, ‘পাঠকরা চালুনিতে ছেঁকে নেবে, ধুলোবালি সব ছেঁকে মণি মাণিক্য রেখে দেবে। আমি মনে করি ধুলোবালি প্রচারের কোনো মানে হয় না। কোনোদিন যদি মণি মাণিক্য রচনা করতে পারি পাঠকেরাই খুঁজে নেবে। অবশ্য পাঠকরা খুঁজে না নিলেও হীরা মণি-মাণিক্যের জৌলুস কমে যাবে না। অর্থ, যশ-খ্যাতি অনেক সময় লেখকের সৃষ্টিশীলতার জন্য ক্ষতিকর।’
লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
কুবি/আনিকা তাসনিম/হাকিম মাহি