ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিকে ধারণ করে বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার্থে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি বাঙলা কলেজ। এটি ১৯৬২ সালের ১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় বাংলা ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে পরিচয় করার চাহিদা থেকে প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম এই কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে স্নাতক পর্যায়ে ২৫ হাজার এবং স্নাতকোত্তরে ৫ হাজার ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে।
প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম বাংলা ভাষা আন্দোলনের একজন ভাষা সৈনিক, যিনি ১৯৬২ সালে বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৪ সালে বাঙলা কলেজ মিরপুরে স্থানান্তরিত হয়। এর আগে প্রতিষ্ঠাকালীন বছরে এর ক্লাস হতো নবকুমার ইনস্টিটিউটে রাতের শিফটে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা বাঙলা কলেজকে একটি বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠার শুরুতে শিক্ষিত বাঙালি বিদ্বান ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিরোধিতায় নেমেছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিলো, বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করলে ছাত্র-ছাত্রীরা চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে। এমনকি ‘বাঙলা মৌলবি’ জন্ম হবে বলেও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাঙলা মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ দ্রুতই জনপ্রিয়তা লাভ করে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর অবাঙালি বিহারিরা বাঙলা কলেজ দখল করে নেয়। দীর্ঘ নয় মাস অবরুদ্ধ ছিলো এ কলেজটি। কলেজের সাইনবোর্ড নামিয়ে এ সময় ‘উর্দু কলেজ’ সাইনবোর্ড লাগানো হয়।
প্রায় ২২ একর জায়গার উপর নির্মিত বাঙলা কলেজ বর্তমানে প্রায় ১৯ টির মতো বিভাগ রয়েছে। এর পাশাপাশি ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনার ব্যবস্থাও চালু রয়েছে
বিজ্ঞান অনুষদ
*রসায়ন বিভাগ
*পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ
*গণিত বিভাগ
*মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগ
*প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ
*উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ
কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদ
*ইংরেজি বিভাগ
*বাংলা বিভাগ
*রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
*সমাজকর্ম বিভাগ
*ইতিহাস বিভাগ
*দর্শন বিভাগ
*ইসলামিক স্টাডিজ
*ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
বাণিজ্য অনুষদ
*হিসাববিজ্ঞান বিভাগ
*ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগ
*অর্থনীতি বিভাগ
*মার্কেটিং বিভাগ
*ব্যবস্থাপনা বিভাগ
উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণী
*বিজ্ঞান
*বাণিজ্য ও
*মানবিক
এছাড়া কলেজটিতে রয়েছে ছেলেদের জন্য একটি আবাসিক হল। আরো একটি নির্মাণাধীন রয়েছে। একটি মসজিদ, সাথে রয়েছে একটি সুপ্রশস্ত একটি মাঠ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৩৫ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর জন্য রয়েছে মাত্র একটি ৪০ সিট বিশিষ্ট বাস ।
কলেজেটির প্রশাসনিক ভবনের পাশেই রয়েছে শহীদ মিনার, যা বাংলা ভাষায় ঐতিহ্যকে লালন করে। এর পাশাপাশি বাঙলা কলেজ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ও ধারণ করে ।
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের নৃশংসতায় ৩০ লক্ষেরও বেশি মানুষ শহীদ হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এটাই সবচেয়ে বড় গণহত্যা।
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বের আনুষ্ঠানিক বিজয় লাভ করলেও ঢাকার মিরপুর হানাদার মুক্ত হয় সবচেয়ে দেরিতে - ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২-এ। মিরপুর এলাকা বিহারি অধ্যুষিত হওয়ায় এখানে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপকতাও ছিলো বেশি। মিরপুর ছিলো মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণক্ষেত্র। বাঙলা কলেজ বধ্যভূমি শুধু মিরপুরেই নয়, বাংলাদেশের অন্যতম একটি বধ্যভূমি।
মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীরা বাঙলা কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে অজস্র মুক্তিকামী মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বর্তমান বিন্যাস অনুযায়ী, কলেজের অভ্যন্তরে বড় গেট ও শহীদ মিনারের মাঝামাঝি প্রাচীর সংলগ্ন স্থানে সেসময় পুকুর ছিলো, যেখানে হানাদার বাহিনী মুক্তিকামী মানুষকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করত। মূল প্রশাসনিক ভবনের অনেক কক্ষই ছিল নির্যাতন কক্ষ। হোস্টেলের পাশের নিচু জমিতে আটককৃতদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হত। অধ্যক্ষের বাসভবন সংলগ্ন বাগানে আম গাছের মোটা শিকড়ের গোড়ায় মাথা চেপে ধরে জবাই করা হতো, ফলে হত্যার পর এক পাশে গড়িয়ে পড়তো মাথাগুলো, অন্যপাশে পড়ে থাকত দেহগুলো।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় জুড়েই বাঙলা কলেজ ও আশেপাশে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলেছে, হয়েছে নারী নির্যাতন। কলেজের বর্তমান বিশালায়তন মাঠটি তখন ছিলো জঙ্গলে ভর্তি। বিজয়ের মুহূর্তে তখন এই মাঠসহ পুরো এলাকা ও কলেজ জুড়ে পড়ে ছিলো অজস্র জবাই করা দেহ, নরকংকাল, পচা-গলা লাশ। বিভীষিকাময় গণহত্যার চিহ্ন ফুটে ছিলো সর্বত্র।
সরকারি বাঙলা কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের সংগঠনের সাথে যুক্ত রয়েছেন। সংগঠনগুলোর মধ্যে বি এন সি সি, রোভার স্কাউট, যুব থিয়েটার, ডিবেট ক্লাব, বাধঁন, সাংবাদিক সমিতি, গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন ক্যাম্পাস অন্যতম।
বর্তমানে অধ্যক্ষ ডা. ফেরদৌসী খানের নেতৃত্বে বাঙলা কলেজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। বাঙলা কলেজের গৌরব আজও সমুন্নত রয়েছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সরকারি বাঙলা কলেজ। ঢাকা/মোহাম্মদ উজ্জ্বল/হাকিম মাহি