ক্যাম্পাস

গৌরবময় ৬৮ বছর

আজ ৬ জুলাই, উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবের সাথে ৬৮টি বছর পার করে আজ ৬৯ বছরে পদার্পণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এই দীর্ঘ পথচলায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রশংসা কুড়িয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে। 

তবে দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে সোচ্চার থাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়টির পথচলা মোটেই মসৃণ ছিল না। উত্তরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে রাজশাহীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানায় সুশিল সমাজ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের লক্ষ্যে ৬৪ জনের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে তীব্র আন্দোলন। আন্দোলন ঠেকাতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার গ্রেপ্তার করে ১৫ জন ছাত্র নেতাকে। এতে করে আন্দোলন আরও গতি পায়। অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাস হয়। 

উত্তরবঙ্গের মানুষের দীর্ঘ দিনের প্রতীক্ষার প্রহর শেষে ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই ড. ইতরাত হোসেন জুবেরীকে উপাচার্য করে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। শুরুতে রাজশাহীর বড়কুঠি ও রাজশাহী কলেজের বিভিন্ন ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ১৯৬১ সালে শহর থেকে ৫ কিলোমিটার পূর্বে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের পাশেই মতিহারের নয়নাভিরাম সবুজ চত্বরে স্থানান্তর করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম।  

প্রাথমিক পদযাত্রায় ১৬১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে পথচলা এই বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার। শুরুতে দর্শন, ইতিহাস, বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, গণিত ও আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১২ অনুষদের অধীনে রয়েছে ৫৯টি বিভাগ এবং উচ্চতর গবেষণার জন্য রয়েছে ৬টি ইনস্টিটিউট। এছাড়াও রয়েছে ১৩টি একাডেমিক ভবন, ১৭টি আবাসিক হল। যার মধ্যে ১১টি ছাত্র ও ৬টি ছাত্রী হল এবং গবেষক ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ডরমেটরি। 

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরপরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সম্মুখ নেতৃত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় রেখেছে অনন্য ভূমিকা। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে দেশের প্রথম বুদ্ধিজীবী হিসেবে শহীদ হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা। তার মৃত্যুতে সারাদেশে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাবানল জলে ওঠে। আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশের ছাত্রসমাজ। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্বেই বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ হবিবুর রহমান, শহীদ মীর আবদুল কাইয়ুম ও শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার। পাকিস্তানীদের অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করেছিলেন গণিত বিভাগের শিক্ষক মজিবর রহমান। এছাড়া আরও ত্রিশ জন ছাত্র, কর্মচারী-কর্মকর্তাও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। এরপর স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমিকা ছিল অতুলনীয়।

বিশ্ববিদ্যালয়টির বুকে দাঁড়িয়ে আছে দেশের বিখ্যাত কয়েকটি ভাষ্কর্য ও স্মৃতিস্তম্ভ। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সাবাস বাংলাদেশ, সুবর্ণ জয়ন্তী টাওয়ার, বুদ্ধিজীবী স্মৃতি ফলক, অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য স্ফুলিঙ্গ, বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ ইত্যাদি।

দীর্ঘ এই ৬৮ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে দেশ গঠন, দেশের শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, ক্রীড়াঙ্গণসহ দেশের বাইরেও বিভিন্ন সেক্টরে অবদান রেখেছেন হাজারো শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামান, কূটনৈতিক এইচ টি ইমাম, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খাইরুজ্জামান লিটন, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, নৌ পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক, অর্থনীতিবিদ সনৎ কুমার সাহা, কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, নাট্যকার মলয় ভৌমিক, সংগীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোর, চলচিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম, জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট, দেশের দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।