১১ জুলাই। ঘড়িতে সময় ঠিক ছ’টা। কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভেঙে হাতে রিমোট নিয়ে টিভি সেটের সামনে বসবেন হাজারো ফুটবলপ্রেমী। অনেকে আবার না ঘুমিয়েই প্রহর গুনবেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। বাঙালি ফুটবলপ্রেমীদের এর থেকে ভালো সকাল আর কী-ই বা হতে পারে!
অবশেষে কোপার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে মাঠে নামছে দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, যা নিয়ে এরইমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয়েছে বাড়তি উত্তাপ। পাড়ার অলিগলি থেকে শুরু হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে যার রোমাঞ্চ, উচ্ছ্বাস। লাতিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে কোন দল ফেবারিট আর কে-ই বা হবে চ্যাম্পিয়ন, এ নিয়ে চলছে চুলচেড়া বিশ্লেষণ।
এদিকে এই লড়াইকে সামনে রেখে নানা যুক্তিতর্কে মেতেছেন দুই দলের সমর্থকেরা। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না তিল পরিমাণও। তবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার এ দ্বৈরথের মাঝে পাল্লা দিয়ে উঠছে ভক্তদের দ্বৈরথও। একই পরিবার, বন্ধুমহল কিংবা প্রিয়জন সবার মাঝেই দেখা যায় কেউ আর্জেন্টিনা আবার কেউবা ব্রাজিল।
তবে এই দু’দলের মধ্যে আর্জেন্টাইন সমর্থকই লক্ষ করা যায় প্রায় সর্বত্র। নারী, পুরুষ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের শ্রেণিপেশার মানুষ আছেন এই লাতিন আমেরিকান দেশটির সমর্থক। ধারণা করা হয় ফুটবল জাদুকর মেসির অসাধারণ নৈপুণ্য ও কলাকৌশলের কারণেই ফুটবলপ্রেমীদের পছন্দের তালিকায় উপরে রয়েছে লাতিন আমেরিকার এই দেশটি। কোপার এই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মহারণকে সামনে রেখে কথা বলেছিলাম দেশের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন আর্জেন্টাইন সমর্থক শিক্ষার্থীর সাথে। কেন তারা সাপোর্ট করেন আর্জেন্টিনা? কেনই বা তারা ভালোবাসেন লিওনেল মেসি নামক এই ফুটবল জাদুকরকে।
রাব্বি হাসান, সরকারি তিতুমীর কলেজ। তিনি বলেন, আসলে কেন পছন্দ করি বা সাপোর্ট করি একথার কোনো উত্তর হয় না। ছোটবেলা থেকেই আমার পছন্দের খেলোয়াড় মেসি। মেসি আর আর্জেন্টিনা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। হয়তো মেসির প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিতে নিতে আর্জেন্টিনা দলটাকেও ভালোবেসে ফেলি। আসলে খেলায় হার জিত না থাকলে খেলায় সাফল্য আসে না। আর্জেন্টিনা কোন খেলায় হারলে হয়তো খারাপ লাগার মাত্রাটা একটু বেশি। একারণেই এত সাপোর্ট করি বা ভালোবাসি।
আর্জেন্টিনা আমার পছন্দের দল। হয়তো মেসির জন্য নয়তো নীল-সাদা জার্সিটার জন্য। তবে ভালোবাসি। আমি চাই আমার দলের জয় হোক। অন্যসব দলের প্রতিও আমার একই পরিমাণ শ্রদ্ধা থাকবে। তবে একটা কথা বলা উচিৎ, তা হলো দল করতে গিয়ে যাতে মানুষে মানুষে কোনো বিবাদ না হয়, বির্তক হোক তবে মারামারি আর ঝগড়া মোটেও কাম্য নয়। খেলাকে খেলার জায়গায় রেখে মানুষে মানুষে মিলেমিশে থাকি।
আতিয়ার রহমান শাহিন, শিক্ষার্থী, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বলেন, আর্জেন্টিনা হলো আমার আবেগ, আর ফুটবলকে এতটা ভালোবাসার প্রধান কারণ। যেই টিমটা সাজানো গোছানো ফুটবল উপহার দিয়ে আসছে, আর বিশ্বসেরা প্লেয়ারদের জন্ম দিয়ে আসছেন। ম্যারাডোনা থেকে মেসির পর হয়তো আরও কোনো নাম যোগ হবে এই কাতারে। ছোটবেলায় আব্বুর মুখে ম্যারাডোনার গল্প শুনেছি আর বড় হয়ে ফুটবল বোঝার পর দেখেছি আর্জেন্টিনার সাজানো গোছানো ফুটবল।
ফারহান শাহরিয়ার তুষার, শিক্ষার্থী, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে যখনই খেলা বোঝা শুরু করি, তখন থেকেই দেখি আর্জেন্টিনার খেলার পরিচ্ছন্ন কৌশল, নৈপুণ্য আর নান্দনিকতা, যেন প্রেমে ফেলে দিয়েছে সেই কিশোর বয়সে! এরপর মেসি, তেবেজ, হিগুয়েন, আগুয়েরো, ডি মারিয়া এছাড়াও অনেক ভালো প্লেয়ার, যাদের পায়ে বল নিয়ন্ত্রণের কৌশল দৃষ্টি নন্দন! ছিল না মাঠে কোনো দাম্ভিকতা কিংবা অসদাচরণ। প্রতিপক্ষ দলের অনেকেই ততকালীন বা অন্যান্য স্ট্রাইকারদের সাথে আক্রমণাত্মক আচরণ করলেও একদমই বন্ধুত্ব পরায়ণ এরা। সেই থেকেই যে লাতিন আমেরিকার দেশটাকে আপন করে নিয়েছি আজও ভালোবাসি তাদের ফুটবল। হ্যাঁ, আমি আর্জেন্টিনার সমর্থক। কারণ, তারা মাঠে নৈপুণ্যতা দিয়ে খেলে, তাই শুভ কামনা এই মাঠ কাপানো সৈনিকদের জন্য।
দেবলিনা চন্দ দৈবী, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বলেন, মূলত লিওনেল মেসির খেলা আমার ভালো লাগে। এজন্যই আমি আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট করি। এছাড়া ২০১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিল, তখন থেকেই তাদের খেলায় মুগ্ধ আমি! বলা যায়, তখন থেকেই আমার পছন্দের দল আর্জেন্টিনা। আর এবার যে নতুন গোলকিপার সেও বেশ চমৎকার। অসাধারণ লেখছে। তাই মনে প্রাণে চাইবো এবার আর্জেন্টিনা কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতুক।
আসমাউল মুত্তাকিম সরকার, শিক্ষার্থী, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই ফুটবল মানে আমার কাছে আর্জেন্টিনা। ডিয়াগো ম্যারাডোনা কিংবা মেসি এক রাশ ভালোবাসার নাম। এক রাশ ভালোবাসা। এক অদৃশ্য আবেগ। ফুটবল বলেই এটা সম্ভব। আকাশী নীল মানেই আর্জেন্টিনা। আকাশী নীলদের খেলা মানে হার্টবিট বেড়ে যাওয়া! ওরা মাঠে নামে। দেখায় ফুটবলের নৌপুণ্য তা। ওরা দেখায় খেলার সৌন্দর্য। মেসির কথা বলতে গেলে মনে হয় ফুটবলের জন্যই হয়তো ঈশ্বর তাকে সৃষ্টি করেছেন। কতটুকু ভালোবাসি তা যেমন পরিমাপ করা যায় না। তেমনি কেন ভালোবাসি সেটাও যেন বলা মুশকিল। তবে এটুকু জানি তাদের খেলা আমার মন টানে।
শুভ্রা চৌধুরী, শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ। তিনি বলেন, আর্জেন্টিনার প্রতি আমার ভালোবাসাটি পারিবারিক ভাবে। কারণ, ছোটবেলায় তো খেলা বুঝতাম না কিন্তু বাসার সবাই বলতো আর্জেন্টিনা, সবাই আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করতো। তখন থেকেই আমিও আর্জেন্টিনার সাপোর্ট করা শুরু করি। এরপর আস্তে আস্তে খেলা দেখা, মেসির অসাধারণ নৈপুণ্য ও কলাকৌশল, মূলত তার খেলা ভালো লাগতো বলেই এই দলটির প্রতি ভালো লাগা শুরু হয়।
মিঠুন রায় সঞ্জয়, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বলেন, সালটা ছিল ২০১০, তখন আমি অনেক ছোট। ফুটবলটা ভালো করে বুঝে ওঠা না হলেও মেসি-নেইমার, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল তর্কে জড়িয়ে পড়তাম সহজেই। কোনো কারণ ছাড়াই আর্জেন্টিনা নিতাম আমি। তখন মোবাইল ফোন তো দূরের কথা, ছিল না বাড়ি বাড়ি টিভির রাজত্বও। খেলা দেখিনি আর্জেন্টিনার তবুও না বুঝেই মেনে নিতাম মেসির আর্জেন্টিনাই সেরা। আসলো বিশ্বকাপ ২০১০। যেহেতু বাসায় বিদ্যুৎ নেই তাই টিভিও ছিল না। বাবার সাথে রাত ১২টায় বের হয়ে যেতাম (ম্যাচ গুলো ১২ টার পরেই ছিল, যতদূর মনে আছে) পাশের গ্রামে এক কাকার বাড়িতে খেলা দেখতে, তাদের বাড়িতে তখন ব্যাটারি দিয়ে টিভি চলতো। সেবারই মেসিকে প্রথম খেলতে দেখেছি।
এর কিছুদিন পর হাতে এলো স্মার্ট ফোন, এবার দেখা শুরু ক্লাব ফুটবল। রাত জেগে ভরা উত্তেজনা নিয়ে খেলাগুলো দেখতাম মেসির। এটা সত্য যে মেসি না খেললে খেলাই দেখতাম না। সারাদিনের হাজার জল্পনা-কল্পনা অবশান নিমিষেই চলে যেতো যখন মনে পড়তো আজ রাতে মেসির খেলা আছে!