ক্যাম্পাস

অনলাইন ক্লাসের ১ বছর: প্রত্যাশার প্রাপ্তি কতটুকু?

করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসময়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান সম্ভব না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মধ্যে রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনায় অনলাইনে পাঠদান শুরু করে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২০ সালের ১২ জুলাই থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও শুরু হয় অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম। দীর্ঘ এক বছরের এই অনলাইন পাঠদান কার্যক্রমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনুভূতি তুলে ধরেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক ইউছুব ওসমান।

করোনা মহামারি বিস্তারের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক প্রকার বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সব কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও দুয়ারে কড়া নাড়ে অনলাইন ক্লাস নামক নতুন অভিজাত ভাবনা৷ বিকল্প হিসেবে সাময়িকভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য নিশ্চয়ই এটি গ্রহণযোগ্য একটি ব্যবস্থা। পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলাতে খুব ভালোভাবেই শিখিয়েছে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা। 

শত কিলো দূরে থেকেও  ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি না পেলেও শিক্ষার আলো গ্রহণে শিক্ষার্থীরা যথাসম্ভব চেষ্টা করেছে। প্রতিটি কাজের যেমন পজিটিভ বা নেগেটিভ দিক থাকে, তেমনটা অনলাইন কার্যক্রমের মাঝেও ছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় অংশের শিক্ষার্থীরা গ্রাম অঞ্চল থেকে শুধুই মেধার দীপ্তি ছড়িয়ে পড়তে আসে। করোনা পরিস্থিতির জন্য পারিবারিক আর্থিক অনটন, ইন্টারনেট জনিত সমস্যা তাদের অধিক মাত্রায় ভুগিয়েছে এমনটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই কারো। 

শতাংশের হিসেবে পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে হিসাব করলে সংখ্যাটা যথেষ্ট লজ্জাজনক হবে নিশ্চয়ই। প্রশাসনের উদার বা মানবিক সহায়তা এ ধরনের সমস্যার সমাধান ও অনলাইন কার্যক্রমকে গতিশীল করতে ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বোপরি, ক্যাম্পাস লাইফ ইজ ক্যাম্পাস লাইফ৷ বাস্তবিকভাবে এটির পুরোপুরি বিকল্প কখনোই তৈরি সম্ভব না। অনলাইনকে সাময়িক সময়ের জন্য ব্যবহার করাটাই শ্রেয়৷ শিক্ষার্থীদের চলমান ভ্যাকসিন কার্যক্রমকে যথাযথভাবে সম্পাদন করা হোক। তবেই আমরা পেতে পারি ক্যাম্পাসের চায়ের কাপে চুৃুমুক দেওয়ার অবারিত সুযোগ। 

অনন্য প্রতীক রাউত, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

চলমান করোনা মহামারিকে প্রতিহত করতে দৈনন্দিন জীবন ধারায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বিশেষ করে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে শিক্ষাখাতে। কোভিড-১৯ প্রতিরোধের গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ আছে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও বন্ধ নেই শিক্ষাব্যস্থা। নতুনত্বের ধারায় শিক্ষা ব্যবস্থায় শুরু হয়েছে অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট ও পরীক্ষাসমূহ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে পড়াশোনাকে পরিচালিত করছে। এক দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকলেও ভার্চুয়াল জগতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ও সহপাঠীদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে অনলাইনের মাধ্যমে। ইউজিসি কর্তৃক জুমের মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ও এই কার্যক্রম শুরু হয়, যার একবছরপূর্তিও সম্পন্ন হলো। 

তবে, নতুন সংস্কৃতির এ যাত্রাপথ সহজ ছিল না। ডিভাইজ স্বল্পতা, নেটওয়ার্কের দুর্বলতা ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল ডাটা প্যাকের জন্য সব শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত থাকার সুযোগ পায়নি। তাই নতুন এ দিগন্তের সূচনায় এতে বেশকিছু অসমতার তৈরি হয়েছে। তবুও পরিস্থিতি মোকাবিলায় এ এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ, যদিও তা কখনই ক্লাসরুমের বিকল্প হতে পারেনি। এখন শিক্ষার্থী সমাজের প্রত্যাশা একটা সুস্থ পৃথিবীতে ক্যাম্পাস অঙ্গনে আবার মিলিত হওয়ার।

রুকাইয়া মিজান মিমি, শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

করোনার প্রকোপে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায় ক্যাম্পাস। তারপর দেখতে দেখতে এক বছরের বেশি সময় ধরে ঘরেই অবস্থান করছি।  অনলাইনে শুরু হওয়া ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, মিড পরীক্ষাগুলোর এক বছরপূর্তি হয়ে গেলো। এই সময়টা সবার জন্য নিতান্তই সহজ ব্যাপার ছিল না। অনলাইন ক্লাসের কারিকুলামে বিষয়গুলো শিক্ষকেরা খুব সুন্দর করে উপস্থান করার চেষ্টা করলেও আসলে সবার আর্থিক সার্মথ্য না থাকায় বেশি মূল্যের ইন্টারনেট প্যাকেজগুলো কিনে প্রতিটা ক্লাসে উপস্থিত হওয়া ছিল একপ্রকার কঠিন যুদ্ধ। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়ি থাকার কারণে কখনো কখনো ইন্টারনেটের গতি দুর্বল হওয়ায় প্রচুর ব্যঘাত ঘটাতো ক্লাসের। 

অনেকের তীব্র চেষ্টা এবং ইচ্ছা থাকার পরও উপস্থিত হতে পারতো না, ব্যাপারটা বরাবরই আমার মনে নাড়া দিতো।  তবে শিক্ষকদের ছিল নিদারুণ সহযোগিতার হাত। তারা খুব সাহায্য করেন শিক্ষার্থীদের। যারা ক্লাস, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে না তাদের সবপ্রকার আর্থিক এবং মানসিক সহযোগিতার মনোভাব তাদের মধ্যে সর্বোদাই সোচ্চার দেখেছি। একটি লেকচার শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য বার বার বোঝানোর চেষ্টাও ছিল খুব। অনলাইন ক্লাসের অনুভূতি অনেকটা কৃত্রিম অনুভূতি। প্রিয় মানুষকে মোবাইল বা ল্যাপটপের স্ক্রিনে দেখা। তবে অনুভূতির কথা ব্যক্ত করতে বললে, আসলে মনে পড়ে যায় যখন সুস্থ শহরে বাস করতাম আমরা। ক্যম্পাসের মুখরিত পরিবেশ। ক্লাস, শান্ত চত্বরের, কাঁঠালতলায় বা সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে লেকচার বোঝানো, একে অপরের সাথে গ্রুপ স্টাডি করার ব্যপারগুলো এই অনলাইনে আর হয় না। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আর দেখাও হয় না। তবে আশা রাখি এই অনলাইন প্রযুক্তি থেকে বেড়িয়ে আবার নিজের প্রাণপ্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরতে পারবো দু'চোখ ভর্তি হাজারো স্বপ্ন নিয়ে। এখন শুধু অপেক্ষা করোনা মোকাবিলা করে সুস্থ শহর ফিরে পাওয়ার।

আনিকা তাহসিন অর্না, শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ

অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন হলো একটি স্মার্টফোন অথবা ল্যাপটপ কিংবা কম্পিউটার।  অনলাইন ক্লাস শুরু হওয়ার প্রথম দিকে দেখা গিয়েছিল যে শতভাগ শিক্ষার্থীর কাছে স্মার্টফোন নেই। এছাড়া যে অ্যাপগুলোর মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হয় যেমন- জুম মিটিং, গুগল ক্লাসরুম, ফেসবুক লাইভ ইত্যাদির সাথে আগে থেকে আমরা অনেকেই পরিচিত ছিলাম না। তবে পরবর্তী সময়ে আমরা সবাই এই অ্যাপগুলোর ব্যবহার অনেক ভালোভাবেই শিখে গিয়েছি। এই করোনাকালে ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের বন্ধু হয়ে শিক্ষাব্যবস্থার হাল ধরে রেখেছে। যদিও ইন্টারনেটের ধীরগতি, স্মার্টফোন না থাকাসহ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাদের। তবুও এই যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দীর্ঘ দিন আমরা ছাত্রছাত্রীরা একসাথে ক্লাসে বসে ক্লাস করা থেকে বিরত রয়েছি, যার অনেকটাই অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। 

এছাড়া প্রথম দিকে আমাদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ অনেকটা কমে গিয়েছিল, যা ভবিষ্যতের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। নানা জটিলতা থাকা সত্ত্বেও প্রযুক্তির আশীর্বাদে এই যে এক বছর ধরে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গণ্ডির বাইরে থেকেও অনলাইনে ক্লাসের মাধ্যমে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারছি, এটা নিশ্চয়ই প্রযুক্তির একটি ইতিবাচক প্রভাব। তবে আমরা চাই শিগগিরই যাতে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পেয়ে আবারও ক্যাম্পাসে নিজেদের ক্লাসরুমে বসে সশরীরে ক্লাস করতে পারি। 

সিদরাতুল মুনতাহা, শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরের জুলাই মাস থেকে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়।  তবে অধিকাংশ শিক্ষার্থী গ্রামের বাড়িতে থাকায় পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সুবিধার অভাবে নিয়মিত ক্লাসে সংযুক্ত হতে পারেনি৷ এছাড়াও অনেক শিক্ষার্থীর ডিভাইস না থাকার ফলেও ক্লাস করতে পারেনি। যা শিক্ষার্থীদের জন্য অনেকটাই পিছিয়ে পড়ার ন্যায়।

আবার এমনও দেখা গেছে যে, অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসে জয়েন্ট হয়ে, ভিডিও অফ রেখে অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় দিয়েছে। এতে করে তারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করেছে৷ তবে অনলাইন ক্লাস কিছুটা হলেও আমাদের সুবিধা দিয়েছে৷ নাহলে একাধারে এত দিন পড়াশোনার বাইরে থাকলে আমরা আরও পিছিয়ে যেতাম।

রিদুয়ান ইসলাম, শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ