দেশ স্বাধীনের পর থেকেই নারীর জীবনমানে অকল্পনীয় পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এই সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা তো কমেইনি বরং নিত্যনতুন কৌশল ও পন্থায় নারীর প্রতি পাশবিকতা এবং নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে। পত্রিকার পাতা উল্টালেই চোখে পড়ে নির্যাতিত, অবহেলিত, বিচারহীন হাজারো নারীর আর্তনাদের গল্প। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েকজন নারী শিক্ষার্থীর ভাবনা তুলে ধরেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ।
আধুনিক সমাজে নারী নির্যাতন লজ্জার
বর্তমান সময়ে করোনাভাইরাসের চেয়েও বেশি বিষাক্ত ‘নারী নির্যাতন’ নামক ভাইরাস। আধুনিক সমাজে নারী নির্যাতন যেন নারীর জন্য এক অভিশাপ। শিক্ষার হার বাড়ার সাথে সাথে নারী নির্যাতনও বাড়ছে সমানতালে। ভোর হতেই কানে আসতে থাকে নারী নির্যাতনের বীভৎস ও হৃদয়স্পর্শী ঘটনার বর্ণনা পাড়াপড়শির, পত্র-পত্রিকা এবং অন্যান্য গণমাধ্যমের বদৌলতে। এসব ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবার, সমাজ তথা দেশের উপর। তবে, বিশেষ করে প্রভাব পড়ছে নারী এবং নারী শিক্ষার্থীদের উপর।
এমন চলতে থাকলে সুস্থ সমাজ বিনির্মাণ অলীক স্বপ্ন। তাই সুন্দর সমাজ গঠনে সুস্থ মানবিকতাসম্পন্ন মানুষের বড্ড প্রয়োজন। একজন নারী শিক্ষার্থী হিসেবে আমি চাই ‘নারী নির্যাতন’ সমূলে উৎপাটন। তাহলেই নারীর পৃথিবী আরও প্রশস্ত হবে, কমবে সংকীর্ণতা।
তাসনীম তামান্না, শিক্ষার্থী, ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নারী মুক্তির হাতিয়ার নারীর হাতেই
সমাজ ও সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই যেন এ প্রবণতা বেড়ে চলেছে। মানুষ যতই সচেতন হচ্ছে, ততই নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে তাদের অজ্ঞতা বৃদ্ধি পাচ্ছে; বৃদ্ধি পাচ্ছে উদাসীনতা। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অশিক্ষাসহ নানা কারণে নির্যাতিত হচ্ছে নারীরা। এক্ষেত্রে অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য না করে তৎক্ষণাৎ আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। নারীর প্রয়োজন নিজের প্রতি লড়াই করার বিশ্বাস। ভয়ভীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রক্ষা করতে হবে নিজেকেই। তবেই নারী নির্যাতন নয়, তৈরি হবে নারীর ক্ষমতায়ন।
আনিকা তাহসিন অর্না, শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ভাঙতে হবে মৌনতা
আমাদের দেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের আইন থাকলেও আইন প্রণয়নের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তাই নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রচলিত আইন প্রণয়নের পাশাপাশি নারীর আর্থিক ক্ষমতায়ন, অধিকার সমতা, নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনয়নের পাশাপাশি নির্যাতনের শিকার নারীদের মৌনতা ভেঙে নির্যাতনের ব্যাপারে মুখ খুলতে হবে এবং প্রতিবাদ করতে হবে।
একমাত্র সচেতনতাই পারিবারিক সহিংসতা ও নারী নির্যাতন রোধ করতে পারে। সর্বোপরি, আইনি প্রতিকারের মাধ্যমে নির্যাতনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রয়োজনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয়ক আইন ও নীতি বাস্তবায়ন নিশ্চিতকল্পে তদারকি সেল গঠন করতে হবে।
রেহেনুমা সেহেলী কবির, শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
আইনের সঠিক প্রয়োগ প্রয়োজন
সম্প্রতি আশঙ্কাজনক হারে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। পথে-ঘাটে, বাসে-ট্রেনে এমনকি বাসা, স্কুল- কলেজ, মাদ্রাসা বা কর্মস্থলে নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে। সভ্যতার এই চরম উৎকর্ষতায় এসে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের নারীরা প্রতিদিনই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, এটা বড়ই দুঃখজনক। বিচারহীন বা ন্যায়বিচারের অভাব একটি সমাজ ধীরে ধীরে অপরাধ প্রবণ হয়ে ওঠে। এ অপরাধ প্রবণতা দূর করতে হলে সর্বাগ্রে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে এবং সেই সাথে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ নারীর জন্য লজ্জার বিষয় নয় বরং এ লজ্জা নির্যাতনকারী ও ধর্ষণকারীর। প্রতিটি দিন হোক নারী নির্যাতনমুক্ত, এটাই প্রত্যাশা।
নাজমুন নাহার জেমি, শিক্ষার্থী, ইসলামীক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
নারী নির্যাতন বন্ধে সুবিচার জরুরি
হাজারো দুঃখ-কষ্ট লুকিয়ে থাকা এক শব্দ নারী। নারী মানে হাজারো স্বপ্ন বিসর্জন দেওয়া এবং স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে লড়াই করে যাওয়া এক টুকরো আত্মবিশ্বাস। এটি শুধু একটি শব্দ নয় বরং এর হাজার অর্থ এবং এতে লক্ষ-কোটি অনুভূতি বিদ্যমান। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এই নারী শব্দটা বড়ই অবহেলিত। নিজের শখ, আহ্লাদ, ইচ্ছে বিসর্জন দেওয়া এই নারী বর্তমানে কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে হাজারো প্রতিবাদ, হাজারো বিক্ষোভ হলেও তাও যেন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
নারী নির্যাতন বন্ধে আইন থাকা সত্ত্বেও নির্যাতনকারীরা সেই আইনে বৃদ্ধ আঙ্গুল দেখিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের কানে যেন তালা। নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন প্রতিরোধে আইনের প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার প্রত্যাশিত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আমাদের নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রতিবাদ করতেই হবে এবং কোনোভাবেই এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। নারী নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনের নজরদারি আরও বৃদ্ধি করতে হবে।
মাইশা শওকত, শিক্ষার্থী, সঙ্গীত বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
যথাযথ পারিবারিক মূল্যায়ন জরুরি
পদে পদে নারীকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়, শারীরিক মানসিক তা যেমনই হোক। নারী হিসেবে সবচেয়ে বড় কারণ যথাযথ পারিবারিক শিক্ষার অভাব। প্রতিটি পরিবারের উচিত তার ছেলে সন্তানকে শিক্ষা দেওয়া, তোমার নিজের বোন ছাড়া বাকি সব মেয়েও তোমার বোনের মতো, তাদের দিকে সেই দৃষ্টিতে তাকানো উচিত। ফাঁকা রাস্তায় একলা চলা কোনো মেয়ে তোমার কামনার বস্তু নয়, যদি পারো তাকে সাহায্য করো, না পারলে তার বিপদের কারণ হতে যেও না। মেয়েদের সিদ্ধান্তকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে পরিবারে, তবেই একটা বাচ্চা শিখবে একটা মেয়ের সাথে কিভাবে আচরণ করতে হয়।
সানজানা হোসেন অন্তরা, শিক্ষার্থী, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।