শিক্ষার্থীদের মুখস্থবিদ্যা থেকে মুক্ত মিলবে ২০২৩ সালে নতুন শিক্ষা কাঠামো বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বদলে যাবে বই, বইয়ের ধরন, সাথে পরীক্ষাপদ্ধতিও। কোনো পরীক্ষাই থাকবে না তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। বাদ যাবে নবম-দশম শ্রেণির বিভাগভিত্তিক পড়াশোনা। পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়নের চেয়ে শ্রেণিকক্ষের ধারাবাহিক মূল্যায়নে জোর দেওয়া হবে বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন শিক্ষা কাঠামো সময়ের চাহিদা।
সময়ের চাহিদা কিনা, তা যাচাই করার আগে একটু অতীতের শিক্ষাক্রমে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। এই উপমহাদেশে প্রথম শিক্ষা কমিশন গড়ে ওঠে ১৮৮২ সালে স্যার উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে। যা ‘হান্টার শিক্ষা কমিশন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই কমিশন ১৮৮৩ সালে সর্বপ্রথম সাহিত্য ও কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রস্তাব করে এবং এই শিক্ষাক্রমই ব্রিটিশ শাসনামলে বহাল থাকে। এরপর ১৯৪৯ সালে ‘মাওলানা আকরাম খান শিক্ষা রিপোর্ট’ অনুযায়ী যুক্তফ্রন্ট একটি সার্বজনীন বিজ্ঞান ভিত্তিক একই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছিল। ১৯৫৭ সালে আতাউর রহমান শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশনও তার রিপোর্টে একই ধারার শিক্ষার কথা বলে।
কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করার পর ‘শরীফ খান শিক্ষা কমিশন’ গঠন করে এবং ১৯৫৯ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় নবম শ্রেণি থেকে সাধারণ শিক্ষাকে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা নামে তিনটি ধারায় বিভক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। আজ পর্যন্ত সেই ব্যবস্থাই প্রচলিত আছে। তবে স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সালে এই শিক্ষা কমিশন উদ্বোধন করেন। সর্বশেষ ২০১২ সালে নতুন শিক্ষাক্রম ঘোষণা হয়, যা ২০১৩ সাল থেকে বাস্তবায়ন হয়ে আসছে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নতুন শিক্ষা কাঠামোর মাধ্যমে আমরা ১৯৬০ সালের একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় ফিরে যাচ্ছি। তবে কেন ৬০ সালের দিকে একমুখী থেকে বহুমুখী শিক্ষা চালু হয়েছিল, কেন প্রথম শ্রেণি থেকেই পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়, সেটি জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
এবারের নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়নের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন হবে। এদের কোনো বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। ৪র্থ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত মোট নম্বরের ৬০ শতাংশ শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন এবং বার্ষিক পরীক্ষা হবে ৪০ শতাংশ নম্বরের। এক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষ মূল্যায়নে শিক্ষক কতটা নিরপেক্ষভাবে এই মূল্যায়ন করবেন, সেটা নিয়েও নানা প্রশ্ন তৈরি হতে পারে। তাই শুরুতে এই ধরনের মূল্যায়নে কম নম্বর রেখে বিষয়টি পাইলট আকারে দেখা যেতে পারে। অতঃপর বিষয়টিতে সাফল্য পাওয়া গেলে শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়নে ধীরে ধীরে নম্বর বাড়ানো যেতে পারে। তবে কোনো শিক্ষক নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন না করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রাখতে হবে।
এছাড়াও ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে বিভাগ ভিত্তিক ১৪টি বিষয় পড়তে হলেও নয়া শিক্ষাক্রমে অভিন্ন ১০টি বিষয় পড়ানো হবে। ভাষা ও যোগাযোগ শেখানোর নিমিত্তে বাংলা ও ইংরেজি বই, গণিত ও যুক্তি শেখাতে গণিত বই, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব শেখাতে সামাজিক বিজ্ঞান বই, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শেখাতে বিজ্ঞান বই, তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি শেখাতে ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানষিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা শেখাতে ভালো থাকা বই, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শেখাতে ধর্ম শিক্ষা বই এবং শিল্প ও সংস্কৃতি শেখাতে শিল্প ও সংস্কৃতি নামে বই পড়ানো হবে শিক্ষার্থীদের। কমে যাওয়া বিষয়ের মধ্যে চারু ও কারু কলা বিষয়টি আছে। নতুন শিক্ষাক্রমে এ বিষয়টি বাদ দেওয়া হলে এই শিক্ষকদের কী হবে?
আবার, সাধারণ স্কুলেও কারিগরি ট্রেড যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণিতে ট্রেড চালু নিশ্চয় ভালো উদ্যোগ। তবে, ভুলে গেলে চলবে না প্র্যাকটিক্যাল নির্ভর বিষয়গুলোতে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব আছে। তাই ট্রেড বিষয়গুলো চালুর জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক ও ল্যাব থাকতে হবে। এজন্য অবকাঠামোও বাড়াতে হবে। বাড়তি অর্থের জোগান দিতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য আমাদের শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বাড়াতে হবে। তাদের আরও বেশি আগ্রহী করতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
বরাবরের মতো যে বিষয়টি উপেক্ষিত হয়ে আসছে, তা হলো আমাদের দেশে এসএসসি পরীক্ষার পর উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি প্রক্রিয়ায় অনেক সময় চলে যায়। এসএসসি পরীক্ষা শেষে ছুটি ও কলেজে ভর্তি হওয়া অবধি প্রায় ৩ মাস সময় চলে যায়। ফলে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী কম সময় পায়। যেহেতু এই স্তরে দুটি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেক্ষেত্রে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এসএসসি পরীক্ষার পর ফলাফল অল্প কয়েক দিনে ঘোষণা করে দ্রুত কলেজে ভর্তি করার মাধ্যমে এবং ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে ডিসেম্বর মাসেই এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সময় বৃদ্ধি করা যেতে পারে। আবার এসএসসিতে একমুখী পড়াশোনা শেষ করে পরবর্তী সময়ে উচ্চমাধ্যমিকে বিভাগ ভিত্তিক পড়াশোনাতে শিক্ষার্থীদের খাপ খাওয়ানোর বিষয়টি মাথায় রেখে উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যক্রম সাজাতে হবে।
একটি ভাবনার বিষয়, নতুন শিক্ষাক্রমের ফলে একটি শ্রেণির ব্যবসা নষ্ট হবে। সরাসরি বলতে গেলে কোচিং ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। কোচিং শিক্ষক ও মালিকেরা চাইবে এই শিক্ষাক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে। এ বিষয়ে সরকারকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। তাই এই এক বছর ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
নতুন শিক্ষা কাঠামোর ভালো-মন্দ যতই আলোচনা করা হোক না কেন, শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা উপযুক্ত হবে এটাই দেখার বিষয়। পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়নে শতকরা কম নম্বর থাকায় পড়াশোনায় শিক্ষার্থীদের উদাসীনতা দেখা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক ও শিক্ষকদের আগের তুলনায় বেশি নজরদারিতে রাখতে হবে শিক্ষার্থীদের। তবে এই পদ্ধতি ভালোভাবে চালু করতে পারলে বা বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার্থীদের জীবনাচরণই বদলে যাবে। প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য, কর্মমুখী ও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক আগামী জীবনব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হওয়ায় ভবিষ্যতের জন্য বেশ মঙ্গলজনক হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।