পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৫ সালে কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বীকৃতি পায় দেশের অন্যতম প্রাচীন এ বিদ্যাপীঠটি। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সাফল্যের ১৬ বছর পূর্ণ করে ১৭ বছরে পদার্পণ করছে জবি। পাশাপাশি ১৬৪ বছরে পা দিয়েছে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ২০ অক্টোবরকে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। গৌরব ও সাফল্যের ১৬ বছরে ক্যাম্পাসের অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেশের উচ্চশিক্ষা প্রসারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এক অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে এর রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস।
১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুলের পরিবর্তিত রূপই আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৭২ সালে বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল রায় তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে এই বিদ্যাপীঠের নামকরণ করেন। ১৮৮৪ সালে এটি একটি দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজ ও ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজে পরিণত হয়।
ওই সময় এটিই ছিল ঢাকার উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কার্যক্রম বন্ধ করে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনমিত করা হয়। তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ডিগ্রির শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গ্রন্থাগারের বইপুস্তক ও জার্নাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সাজাতে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ গ্রন্থাগারের ৫০ ভাগ বই দান করা হয়। পুরনো ঢাকার নারী শিক্ষায় বাধা দূর করতে ১৯৪২ সালে সহশিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৪৮ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পরে ১৯৪৯ সালে আবার এই কলেজে স্নাতক পাঠ্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান পুনরায় সহশিক্ষা চালু করেন। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি সরকারিকরণ করা হলেও পরের বছরেই আবার এটি বেসরকারি মর্যাদা লাভ করে। ২০০৫ সালে মহান জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ পাসের মাধ্যমে এটি একটি পরিপূর্ণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। পূর্বতন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে গণ্য হয়। তাদের নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। ২০০১-০২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সনদ লাভ করেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০০৫-২০০৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়টি ১১ দশমিক ১১ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি অনুষদে ৩৬টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউটে প্রায় ৬৭৯ জন শিক্ষক, ১৩ হাজার ১৬৫ জন শিক্ষার্থী, ৬৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নতুন হলেও প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে সুদীর্ঘ দেড়শ বছরেরও পুরনো ইতিহাস। বাংলদেশের ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুথান ও মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি আন্দোলনের ইতিহাসে জগন্নাথের অবদান কখনো অস্বীকার করার মতো নয়। পাকিস্তান আমলে সরকার বিরোধী আন্দোলন করায় প্রতিষ্ঠানটিকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে একাট্টা হয়ে জগন্নাথের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বরাবরের মতোই ছিল উল্লেখ করার মতো। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সংশোধনী প্রস্তাব বাতিল হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রদের মিছিলের মাধ্যমে ঢাকায় প্রথম প্রতিক্রিয়া শুরু হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি। এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ঢাকা শহরের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে। ভাষা আন্দোলনের সময় জগন্নাথ ও মেডিক্যাল কলেজে আলাদা করে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে উঠেছিল।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত প্রথম পুস্তিকা ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ এবং সাব-টাইটেল ছিল ‘কি ও কেন’? যার লেখক ছিলেন জগন্নাথের সাবেক শিক্ষার্থী অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এই আন্দোলনে সর্বপ্রথম শহীদ হন জগন্নাথের ছাত্র রফিক উদ্দিন আহমদ। ৫২ সালে তিনি জগন্নাথের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম যে ১০ জন ১৪৪ ধারা ভেঙে ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র প্রখ্যাত কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান।
ভাষা সৈনিক মো. আবদুল জলিল এই প্রতিষ্ঠানে পড়া অবস্থায় ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। ৫২ সালে জগন্নাথ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শফিউদ্দিন আহমদকে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করায় কারাবরণ করতে হয়। ভাষা সৈনিক অজিত কুমার গুহ ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট জগন্নাথে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করে একটানা প্রায় ২০ বছর কর্মরত ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের একজন বলিষ্ঠ সংগঠক হিসেবে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাতীয় অধ্যাপক ড. সালাহউদ্দীন আহমেদসহ অন্য শিক্ষকরা এখান থেকেই ছাত্রদের ভাষা আন্দোলনে উৎসাহিত করতেন। নুরু মোল্লা ১৯৫০ সালে এই প্রতিষ্ঠানে পড়ার সময় ‘সর্বদলীয় সেন্ট্রাল কমিটি অব একশান’ নামে একটি কমিটি হয়। তিনি ওই কমিটির সদস্য ছিলেন। জগন্নাথের সাবেক শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা এম. আমিরুল ইসলাম ১৯৫২ সালে চলমান ভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তান গণপরিষদে লিয়াকত আলী খানের প্রস্তাবিত ‘Basic Principle Report’ এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও ভাষা আন্দোলনে জগন্নাথের অবদানের প্রমাণ পাওয়ায় যায়। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘‘১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হলো। সামান্য কিছুসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাড়া শতকরা ৯০ ভাগ ছাত্র এই আন্দোলনে যোগদান করলো। জগন্নাথ কলেজ, মিডফোর্ড মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বিশেষ করে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলো’’। সাবেক এমপি মরহুম আবদুর রব, মৃণাল বারড়ি ও খলিলুর রহমানের মতো জগন্নাথের নাম নাজানা অসংখ্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের বীজ মূলত জগন্নাথ ও ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস থেকেই বপন করা হয়। ঐতিহাসিক শিক্ষা আন্দোলনের নেতা হায়দার আকবর খান বলেন, ‘‘যতদূর মনে পড়ে জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্র প্রথমে ছাত্র সমস্যার দিকে দৃষ্টিপাত করে কলেজ থেকেই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। পরবর্তী কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা এই আন্দোলনটি আঁকড়ে ধরেন’’। তৎকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ছয় দফা আন্দলনেও জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষিত হলে তার সমর্থনে সফল হরতাল পালনে ভূমিকা পালন করে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজিব বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান কাজী আরেফ আহমেদ ও চিত্র নায়ক ফারুক।
১৭ জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হলে জগন্নাথ ছাত্র সংসদের উদ্যোগেই প্রথম প্রতিবাদ সভা হয়। বঙ্গবন্ধু জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছিলেন, “I am at the disposal of the students of Jagannath College.” ১১ দফার অন্যতম দাবি ছিল তৎকালীন জগন্নাথ কলেজসহ সব প্রাদেশীকীকরণ কলেজসমূহ পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া। ১৯৬৯ এর গণঅভুত্থানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিরোধীতায় কলেজটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সরকার বাধ্য হয়।
সর্বশেষ মহান মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল হিসেবেই মূলত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ২৫ মার্চ ১৯৭১, পাক বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট মিশনের প্রথম দিকে হামলা চালানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। শুরু হয় গণহত্যা। জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা হল থেকে বের হয়ে পুরান ঢাকার রাজপথে প্রতিবাদ শুরু করে। পুরান ঢাকা নিজেদের দখলে নিতে ক্যাম্পাসে তৈরি হয় হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। প্রতিদিন পুরান ঢাকার মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে হত্যা করার পর গণকবর দেওয়া হয় এই ক্যাম্পাসে। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে কর্তৃপক্ষ সে সময়কার ছাত্রসংসদ কার্যালয়ের সামনে গণকবর খনন করে সাতটি কঙ্কালসহ ছেঁড়া কাপড়, জুতো ইত্যাদি উদ্ধার করে। যুদ্ধের পর দৈনিক পূর্বদেশ ও দৈনিক বাংলা পত্রিকায় জগন্নাথে পাক বাহিনীর নির্যাতন ও গণহত্যার ওপর প্রতিবেদন ছাপানো হয়। প্রতিবেদনে ভয়াবহ নারী নির্যাতন ও বিপুল সংখ্যক লোকের কঙ্কাল পাওয়ার খবর প্রকাশ পায়।
মুক্তিযুদ্ধে জগন্নাথের বহু ছাত্র ও শিক্ষক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীরবিক্রম) ও গণিত বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. আবুল কালাম আজাদ। বিজয় লাভের পূর্ব মুহূর্তে আবুল কালাম আজাদকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি আমাদের মাঝে এখনো ফিরে আসেননি। মুক্তিযুদ্ধে এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র মিরাজ, আজমল, নজরুল ও শাহাবুদ্দিন শহীদ হন।
স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর সংঘটিত অর্বণীয় নির্যাতন এবং গণহত্যার চিত্র তুলে ধরে শহীদদের স্মরণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ নির্মাণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও একাত্তরের গণহত্যা ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত, যা দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য। ২০১০ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি অনুদান বহাল রাখতে রাজপথে নেমে এসেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তুমুল আন্দোলনের মুখে জগন্নাথসহ ৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি অনুদান বহাল রাখতে মহান জাতীয় সংসদে বিল পাস করা হয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব কৃতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নাম গর্ব করে বলতেই হয় তাঁরা হলেন- শিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শওকত আলী, আখতারুজ্জামন ইলিয়াস, ইতিহাসবিদ ড. মাহমুদুল হাসান, সাংবাদিক রাহাত খান, আ ন ম বজলুর রহমান, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, সঙ্গীত শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী, ড. শামসুজ্জামান খান, হায়াৎ মাহমুদ, বিক্রমপুরের ইতিহাস খ্যাত লেখক শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, গবেষক গোলাম মুরশিদ ও মির্জা হারুণ-অর রশিদ, বাংলাদশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ, কথা শিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান, প্রখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্র বিশারদ যোগেশচন্দ্র ঘোষ, শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক, ইংলিশ চ্যানেল পাঁড়ি দেয়া সাঁতারু ব্রজেনদাস, বাঙালি কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র, চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, লেখক ও দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দীন আহমেদ রাজু, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র সাইদ খোকন, অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত, লেখক কাজী মোতাহার হোসেন, সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এ.আর.ইউসুফ, গায়ক ফকির আলমগীর, কিরণ চন্দ্র রায়, হায়দার হোসেন ও বিপ্লব, অভিনেতা এ.টি.এম.শামসুজ্জামান, জাহিদ হাসান, মীর সাব্বির, ফারুক ও প্রবীর মিত্র এবং জাদুকর জুয়েল আইচ।
ক্রীড়াক্ষেত্রেও একসময় খ্যাতি ছিল এই বিদ্যাপীঠের। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয়, আন্তঃকলেজে ধারাবাহিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন ছাড়াও শিক্ষার্থীরা জয় করেছিল রোনাল্ডসে শিল্ড, স্যার এ এফ রহমান শিল্ড, ফিরোজ নূন কাপ প্রভৃতি। এই বিদ্যাপীঠেরই শিক্ষার্থী ব্রজেন দাস ৬ বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে গড়েছেন বিশ্ব রেকর্ড। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীই জানে না ক্রীড়ায় তাদের এই গৌরবের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়াজগৎ অনেকটাই মলিন। ক্রীড়াচর্চার পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় বড় পর্যায়ে সাফল্য দেখাতে পারছে না জবিয়ানরা। ২০১৯ এসএ গেমসে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক জয়ী মারজান আকতার প্রিয়া এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষার্থী।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জবির পরিমাপ করা যাবে না। জবিকে জ্ঞানের সূর্য বলা যায়। যা ১৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কেবল জ্ঞানের আলো দিয়েই যাচ্ছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, দেশকে উজাড় করে দিলেও বলার মতো জবি কিছুই পায়নি। জবিকে এখনো অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লজ্জা বহন করতে হয়। অবকাঠামোগত সমস্যা ও বাজেট বৈষম্যের শিকার বিশ্ববিদ্যালয়টি। ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য নেই পর্যাপ্ত পরিবহন ও ক্যান্টিন সুবিধা। তবে খুশির বিষয় এই যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গত ৯ অক্টোবর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। যার মাধ্যমে কেরানীগঞ্জে প্রায় ২০০ একর জায়গার উপর নির্মিত হবে আধুনিক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের একমাত্র অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এই অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমা ঘুচিয়ে ক্যাম্পাসের বিপরীত পাশে বাংলাবাজার সংলগ্ন ছাত্রীদের জন্য ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল’ নামে ১৬ তলাবিশিষ্ট ১ হাজার আসনের একটি হলের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তবে উদ্বোধন হলেও এখনো চালু হয়নি হলটি। আবাসন ও যানবাহন সমস্যায় জর্জরিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনোবল, সাহস ও পরিশ্রমী মানসিকতা অবাক করে অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের। ব্যয়বহুল ঢাকা শহরের মেস-বাসা-বাড়িতে কষ্টে দিন পার করা সত্ত্বেও তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে সর্বদা মাতিয়ে রাখে।
শুধু আন্দোলন আর সংগ্রামেই থেমে নেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নিজেদের জানান দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে জবির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টির সব বিভাগে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু রয়েছে। অনেক আগেই ইউজিসির প্রতিবেদনে এ-গ্রেড ভুক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। বিসিএসসহ সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সামর্থ্য অর্জন করেছে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ভর্তি পরীক্ষাতে গোপন বার-কোড পদ্ধতি চালু করার মাধমে জালিয়াতি রোধে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আর ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথমবারের মতো চালু হয় লিখিত ভর্তি পরীক্ষা।
বাংলাদেশের জন্ম ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই ইতিহাস থেকে অবশ্যই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। তবেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সার্থকতা লাভ করবে।
লেখক: শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।