ক্যাম্পাস

শীতের চাদরে মোড়ানো কুবি ক্যাম্পাস

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঘুরে যে কেউ বলতে বাধ্য যে, প্রকৃতি নিজ হাতে সাজিয়েছে এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি আনাচ-কানাচ। কুবিতে ঋতুর পালাবদলে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য যেন আরও হাজারগুণ বেড়ে যায়। এই তো সেদিন শরতের শুভ্রতা আর মেঘের ভেলা পেরিয়ে এসেছে হেমন্ত। প্রকৃতিতে দেখা দিয়েছে ভিন্ন রূপ, ভিন্ন আমেজ। পাহাড়ি ক্যাম্পাসের আঙ্গিনা এখন ভোরের পাখি আর শিক্ষার্থীদের কলকাকলীতে একদম প্রাণবন্ত। ভোরের সূর্যের স্নিগ্ধ আলোতে লালমাটির এই ক্যাম্পাসের ঘাস আর পাতা ঝলমল করে উঠছে। 

ভোরের সৌন্দর্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করছে শুভ্র অপরূপ শিউলী ফুল। বিবিএ ফ্যাকাল্টির পাশের ঢালুতে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সারি সারি শিউলী ফুলে ভরা প্রাঙ্গণ এক অপার্থিব দৃশ্য সৃষ্টি করে রেখেছে। ভোরবেলা অনেককেই সেসব শিউলী গাছের নিচে ফুল কুড়াতে দেখা যায়। মনে পড়ে যায় নজরুলের সেই গানের কথা- ‘শিউলী তলায় ভোরবেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লীবালা’। তবে ক্যাম্পাসের প্রকৃতি যেন হেমন্তকে এবার সময় খুব কমই দিলো। ভোরে চিকচিক করা শিশির কণা জানান দিচ্ছে ঋতু পরিবর্তনের খবর। সূর্যের স্নিগ্ধ আলো আর কুয়াশার মিশেল শীতের খবর জানান দিলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে লাল পাহাড়ের কোলে নেমে আসে তাপের তীব্রতা৷ তবে সন্ধ্যা নামার আগে আগেই যেন শীত তার সম্পূর্ণ হিমেল রূপ নামিয়ে দেয়৷ 

ছবি: শাহাদাত বিপ্লব

শিশির ভেজা লাল পাহাড়ের শরীর বেয়ে নামে স্নিগ্ধ সকাল। হেমন্তের সকালে ক্যাম্পাসের এমন মায়াবী প্রকৃতি দেখতে বেরিয়ে পড়েন অনেকেই। শিশির ভেজা কুয়াশা জড়ানো শহীদ মিনারের রাস্তায় চলে অনেকের প্রাতঃভ্রমণ, শরীরচর্চা, সাইক্লিং। ক্যাম্পাস গেট পেরিয়ে গোলচত্বর, মুক্তমঞ্চ সবকিছুই প্রকৃতিপ্রেমীদের ডেকে নিয়ে আসে স্নিগ্ধ সকালে শীতের রূপ-রস আস্বাদনে। তবে প্রকৃতির নিজ হাতে সাজানো কুবি ক্যাম্পাসে শীতের রুক্ষ রূপ একটু দেরিতেই আসে। 

ক্যাম্পাসের বিচিত্র রকমের ঘন সবুজ গাছ লতাপাতা, রঙিন ফুল, ঘন জঙ্গল এসব কিছু দেখে বোঝার উপায় নেই যে শীতের আগমন হচ্ছে। হেমন্তের বিকেলের দিকে ক্যাম্পাসে নামে মানুষের ঢল। আড্ডা, গান আর গিটারের টুংটাংয়ে কাটে বিকাল-সন্ধ্যা। সাথে থাকে হাকিম মামার ভ্রাম্যমাণ দোকানে ফুচকা, ভেলপুরি এবং ঝালমুড়ি খাওয়ার ভিড়। 

ছবি: রিসাল হাসান

মৃদু হিম আর কুয়াশায় মোড়া গোধূলীর অল্প আলো ক্যাম্পাসের প্রকৃতিকে করে তোলে আরও রহস্যময়, আরও মোহনীয়। সেইসঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করে রাস্তার ধারে ধোঁয়া ওঠা চিতই আর ভাপার অসাধারণ গন্ধ। এই সময়টায় দুপুরের পর থেকেই ক্যাম্পাসের আশেপাশে বসে যায় পিঠাপুলির দোকান, যেখানে প্রাধান্য থাকে চিতই আর ভাপা পিঠার। তবে দোকানগুলোতে ভিড় বাড়তে থাকে সন্ধ্যার পর থেকে। তখন যেন চিতই পিঠার দোকানে ভিড় লেগেই থাকে। সাথে বিভিন্ন রকমের ভর্তার স্বাদ নেওয়ার জন্য। সালমানপুরের একদম ভেতরে থাকে এক দম্পতি। তারাই ক্যাম্পাস সংলগ্ন দক্ষিণ মোড়ে খুলে বসেছে চিতই পিঠার দোকান। 

বাড়ি থেকে শুঁটকি, সরিষা, রসুন কিংবা মরিচের ভর্তা বানিয়ে নিয়ে আসেন তারা। এখানে বসে দুজন মিলে গল্প করতে করতে বানান চিতই পিঠা। গোলা বানিয়ে দিয়ে স্ত্রীকে সাহায্য করতে থাকে স্বামী। ক্যাম্পাস পেরিয়ে কোটবাড়ি বোর্ড মার্কেটেও বসে পিঠার সমারোহ। নারকেল আর গুড়ের গন্ধে ম ম করতে থাকে আশপাশ। ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা খেতে ভিড় জমান সব ধরনের মানুষ। 

কুবি ক্যাম্পাসের ঋতুচক্রে অন্য পাঁচটি ঋতু চেয়ে শীতকাল একটু ভিন্ন বৈশিষ্ঠ্যের। ক্যাম্পাসের অনেক অয়োজন যেন শীতের আগমনের অপেক্ষাতেই প্রহর গুণতে থাকে।

ছবি: শাহাদাত বিপ্লব

ক্যাম্পাসের আশেপাশের গ্রামের রাস্তাগুলো শীতকালে শিক্ষার্থীদের প্রাতঃভ্রমণে মাঝেমধ্যেই মুখর হয়ে ওঠে। বাতাসে নতুন ধানের গন্ধ যেন ভেসে বেড়ায় প্রকৃতি ও পরিবেশে। গ্রামের ভেতরের গাছিদের কলস ভরে ‘খেজুর রস’ নিয়ে আসার নান্দনিক দৃশ্য যেন ভোলার নয়। খেজুরের ‘কাঁচা রস’ রোদে বসে খাওয়ার মধ্যেই একটা আলাদা স্বাদ আছে। বাচ্চাদের খেজুরের মিষ্টি রস আর মুড়ি খাওয়ার দৃশ্য সবার মন কাড়ে। রুটি দিয়ে পায়েস খাওয়ার কথা ভাবলেই যেন মনে হয় এমন বাংলায় বারবারই শীত ফিরে আসুক।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।