করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের প্রকোপ বাড়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবারও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই করোনার কারণেই ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে দেড় বছরের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ধীরে ধীরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সশরীরে সচল হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আনাগোনায় আবারও মেতে ওঠে প্রতিটি শিক্ষাঙ্গন। অথচ নতুন বছরের শুরুতেই আবার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রাথমিকভাবে ছুটি দুই সপ্তাহ হলেও তা যে আরও বাড়বে না, কোনো নিশ্চয়তা নেই।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা হলেও অনলাইনে কার্যক্রম চলমান রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই তথাকথিত অনলাইন ক্লাসের সুফল যে নিতান্তই নগণ্য, তা বিগত অভিজ্ঞতায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে আর অজানা নয়। করোনাকালে এর আগেও টেলিভিশন, বেতার ও কিছু দৈনিক পত্রিকায় ও অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান ছিল। কিন্তু তার সুফল থেকে বঞ্চিত অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থী। সম্প্রতি ব্র্যাকের একটি জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৫৬ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল।
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশে মোবাইল, টেলিভিশন তথা অনলাইনের আওতায় মাত্র ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, দারিদ্র্যতা, দুর্বল নেটওয়ার্ক কাঠামো, গ্রামীণ প্রত্যন্ত এলাকা, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল প্রভৃতি কারণেই এমন ফল এসেছে জরিপে। এটি তো কখনো কাম্য নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় কোমলমতি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় অনেক শিশু মারাত্মকভাবে মোবাইল ও কম্পিউটার গেমসে আসক্ত হয়ে পড়েছে। দারিদ্র্যতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী কর্মের খোঁজে জড়িয়েছে শিশুশ্রমে। অসংখ্য মেয়ে শিক্ষার্থী শিকার হয়েছে বাল্যবিবাহের। আর মাদকাসক্তির মতো ভয়াবহ প্রভাব তো আছেই। এইচএসসি পরীক্ষার পরিবর্তে দেওয়া হলো অটোপ্রমোশন, যার সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি পরিলক্ষিত হয়। উচ্চশিক্ষার সমস্যা তো আরও প্রকট। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হল বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের নিজ বাড়িতে গিয়ে অবস্থান করতে হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেক শিক্ষার্থীই আসে গ্রামীণ অঞ্চল থেকে। তাদের পক্ষে অনলাইন ক্লাস, পরীক্ষায় অংশ নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়াও অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ। দুর্বল নেটওয়ার্ক কাঠামো, পারিবারিক অসচ্ছলতা, টিউশন সুবিধা না থাকার মতো আরও বহু সমস্যার মধ্য দিয়ে গিয়েছে দেশের উচ্চ শিক্ষার্থীরা। যথা সময়ে চাকরির পরীক্ষা না হওয়া, সেশনজটসহ নানা কারণে শিক্ষার্থীরা চরম দুশ্চিন্তা ও দুরবস্থার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছে দেড়টা বছর। ফলে বেড়েছে হতাশা, বেড়েছে আত্মহত্যার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সম্প্রতি এক রিপোর্টে উঠে এসেছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ১০১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, যার মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই ৬২ জন। বিষয়টি নিসন্দেহে খুবই ভয়াবহ আর অপ্রত্যাশিত। এই হতাশার অবসান হতে না হতেই আবারও সেই কালো আবছায়া ঘনিয়ে এলো শিক্ষাঙ্গনে।
কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখা তো কোনো সমাধান হতে পারে না। এভাবে আর কতো! এ মহামারি অতি সহজে পৃথিবী থেকে চলে যাবে বলে কোনো আশার আলো পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এই 'নিউ নরমাল'র সাথে যতো দ্রুত সম্ভব নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। একজন শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী সরাসরি শিক্ষাদানে বা শিক্ষা গ্রহণে যতোটা সক্রিয় ও প্রাণোচ্ছল, অনলাইন শিক্ষায় তা কখনোই সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। অনলাইন শিক্ষার জন্য এখনো অনেক শিক্ষক আছেন, যারা অনলাইন ক্লাসে অনীহা দেখান। শিক্ষার্থীরাও তাদের সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হয় এই ডিভাইস মাধ্যমের ক্লাসে। তাছাড়া যেসব বিষয়ে ব্যবহারিক আছে, তার ভোগান্তির তো কোনো অন্ত নেই। তাই যথাযথ শিক্ষণফল অর্জনের ব্যর্থতা থেকে যাচ্ছেই।
কঠোর স্বাস্থ্যবিধি, নিরাপত্তা, স্যানিটেশনের পর্যাপ্ত সুযোগ মেনে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রাখা অসম্ভব নয়। প্রয়োজনে শ্রেণিভিত্তিক পৃথক দিবসে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হোক, পৃথক শিফটে পাঠদান অব্যাহত রাখা হোক। শ্রেণিকক্ষে জায়গা সংকুলান না হলে প্রয়োজনে খোলা বা উন্মুক্ত মাঠে চলুক পাঠদান কার্যক্রম। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়াও আমাদের জন্য এই কোভিড-১৯ এরই একটা শিক্ষা। এমনকি শিক্ষার বিপর্যয় ঠেকাতে কোনো রকম অজুহাত ছাড়া আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক তহবিল ইউনিসেফ। তাই এভাবে গণহারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ না রেখে নেওয়া হোক যথোপযুক্ত পদক্ষেপ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ নয় বরং কিভাবে খোলা রেখে শিক্ষায় প্রাণ ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে এখনই কাজ করতে হবে। জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষা। এই মেরুদণ্ড আরও ভঙ্গুর হয়ে যাওয়ার আগেই এই সমস্যার সমাধান জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই, তাছাড়া অন্য কিছুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিকল্প হতে পারে না।
লেখক: শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।