টেক্সটাইল প্রকৌশল বিষয়ে বিস্তর গবেষণা ও দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যকে সামনে রেখে এক যুগ আগে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) প্রতিষ্ঠিত হয়। টেক্সটাইল প্রকৌশল নিয়ে বিশেষায়িত এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রধান ল্যাবগুলোতে ঘুরে পাওয়া যায় নানা সমস্যা। ল্যাবে ব্রিটিশ আমলের পুরোনো মেশিনের ব্যবহার, আধুনিক মেশিন থাকলে তা সংখ্যায় কম। আবার যেসব মেশিন রয়েছে সেগুলোর বিভিন্ন সমস্যা এবং চালিয়ে না দেখানোর অভিযোগ পাওয়া যায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের অধীনের ইয়ার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং ও ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান চারটি ল্যাব ঘুরে দেখা যায়, কোনোটির মেশিন পুরোপুরি নষ্ট, কোনোটির মেশিন পার্টসে সমস্যা আবার কোনোটির পাওয়ার সাপ্লাইয়ে সমস্যা।
ইয়ার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কটন স্পিনিং ল্যাবের ২৮টি মেশিনের মধ্যে ৭টি নষ্ট। যার মধ্যে রয়েছে বেল ব্রেকার মেশিন, মডার্ন সিমফ্লেক্স মেশিন, রিং ডাবলিং মেশিন, এয়ারজেট স্পিনিং মেশিন, টেক্সারাইজিং মেশিন, ওয়াইন্ডিং মেশিন ও ১টি রিভলভিং কার্ডিং মেশিন। মেশিনগুলোতে যেসব সমস্যা পাওয়া যায় তা হলো- সার্কিট সমস্যা, হিট কন্ট্রোল সমস্যা, অভ্যন্তরীণ ইলেক্ট্রনিক সমস্যা, কম্প্রেসর সিস্টেমে সমস্যা ইত্যাদি।
একই বিভাগের জুট স্পিনিং ল্যাবে ১২টি মেশিনের মধ্যে ৪টি মেশিন নষ্ট দেখা গেছে। যার মধ্যে রয়েছে- অটোমেটিক ব্যাচ মিক্সার মেশিন, সফেনার মেশিন, স্লিপ ডাফট স্পিনিং ফ্রেম মেশিন ও স্পোল ওয়াইন্ডিং মেশিন।
ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের উইভিং ল্যাবের ২৫টি মেশিনের মধ্যে ৬টি মেশিন নষ্ট অবস্থায় পাওয়া যায়। সেগুলো হলো- হাই স্পিড ওয়ার্পিং মেশিন, তিনটি ভিন্ন জ্যাকার্ড মেশিন, প্রজেক্টাইল লোম ও মাল্টিফেজ মেশিন।
তবে একই বিভাগের নিটিং ল্যাবের ৮টি মেশিনের মধ্যে একটিতে সমস্যা দেখা গেছে। সেটি হলো অটোমেটিক শক নিটিং মেশিন।
ল্যাবে বিদ্যমান সমস্যার কথা উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আল জাবের রাফি বলেন, ‘ল্যাবে যদি মেশিনের অপারেশন দেখা না যায়, তাহলে ল্যাব আর থিওরি ক্লাসের মধ্যে তফাত থাকে না। কিছু মেশিন অচল অবস্থায় আছে। শোনা যায়, এতে পাওয়ার সাপ্লাইয়ে সমস্যা। শুধু পাওয়ার সাপ্লাইয়ের জন্য যদি ল্যাবের সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে কেন এর সমাধান করা হচ্ছে না।’
নিটিং ল্যাব প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক বলেন, ‘নিটিং ল্যাবের মেশিনের সংখ্যা যথেষ্ট। নিটিং ভালোভাবে শেখার জন্য যেসব মেশিন প্রয়োজন প্রায় সবই প্রায় আছে। কিন্তু নিটিং কোর্স অন্যান্য কোর্সের তুলনায় কঠিন। মেশিনগুলো চালিয়ে দেখানো হলে বুঝতে আরো সুবিধা হতো। কিন্তু সেটা না করানোয় মেশিনের কার্যপ্রক্রিয়া আয়ত্ত করা সম্ভব হয়নি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইজ অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কিছু পুরোনো মেশিন রয়েছে, যা ইন্ডাস্ট্রি পর্যায়ে অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। শিক্ষকরা বলে থাকেন, আধুনিক মেশিন শেখার আগে পুরোনো মেশিন শেখা লাগে। কিন্তু এতে ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরিতে গিয়ে আধুনিক মেশিনের কার্যকারিতা আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সঙ্গে ততটা মিল পাওয়া যায় না। আধুনিক যুগে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে পুরোনো মেশিনগুলো দিয়ে একটি টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়াল মেশিনের কোন অংশ থেকে কোন অংশে অবতরণ করে তা শেখানো হয়। মেশিন কোনোটা নষ্ট আবার কোনোটা সচল থাকলেও চালিয়ে দেখানো হয় না।’
৪৪তম ব্যাচের ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী সাকিব হাসান বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘সব মেশিন যে চালিয়ে দেখতে হবে এমনও নয়। ল্যাবে মেশিনের মেকানিজম দেখতে হয়। তা মেশিন না চালিয়েও ভালোভাবে শেখা যায়। এতে মেশিনের শেখানোর উদ্দেশ্য সফল হয়। আবার সব মেশিন চালু রাখাও সম্ভব না। ল্যাবে জায়গার স্বল্পতা রয়েছে। সময় ও আগ্রহের কারণে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের শেখা হয়ে ওঠে না।’
ইয়ার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বাশার উদ্দিন বলেন, ‘সচল মেশিনগুলো চালিয়ে দেখানোর জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। ইয়ার্ণ ল্যাবের মেশিনগুলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল বা বড় আকারে হওয়ায় ১০০ মিনিটের ল্যাবে শিক্ষার্থীরা মেশিনের বিস্তারিত শেখানোর পর সময় স্বল্পতার কারণে অনেক সময় তা চালিয়ে দেখানো সম্ভব হয়ে ওঠে না, ম্যাটেরিয়ালসহ প্রসেস দেখানো তো আরও সম্ভব হয় না।’
তিনি সমাধান হিসেবে বলেন, ‘ল্যাবে যেসব মিনিয়েচার মেশিন (বৃহৎ আকৃতির ছোট রূপ) রয়েছে, সেগুলো অন্তত চালিয়ে ল্যাব স্কেলে ম্যাটেরিয়াল ইনপুট ও আউটপুট সহজেই দেখানো যায়। সেক্ষেত্রে প্রতিটা ল্যাবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনের পাশাপাশি আধুনিক মিনিয়েচার মেশিন সংযোজন করা যায়।’
একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ছাত্রাবস্থায় ল্যাব ছিল ৩ ঘণ্টার। আর এখন ল্যাব হচ্ছে ২ ঘণ্টার। শিক্ষার্থীও বেড়েছে, এই কম সময়ে ল্যাবে শিক্ষকরা ক্লাস নিবে, ভাইবা নিবে নাকি মেশিন চালিয়ে দেখাবে! তবে ল্যাবের সময় বাড়ানো উচিত।’
ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এটিএম ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘অচল মেশিনগুলো ঠিক করানোর জন্য বাজেট প্রয়োজন হয়। এবার প্রজেক্টাইল লোম মেশিন চেষ্টা করছি ঠিক করার। আধুনিক মেশিনগুলো চলিয়ে দেখার মতো অবস্থায় রাখা প্রয়োজন। আবার কিছু মেশিন আছে যা আধুনিক মেশিনের ম্যাকানিজম বোঝার জন্য আগে জানা প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন চেষ্টা করছে ইউজিসি থেকে বাজেট বাড়িয়ে আনার। বাজেট পেলে মেশিনগুলো ঠিক করা হবে।’
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স)।
পড়ুন: যে কারণে বুটেক্সে এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী পাস করেননি