‘চন্দ্রগর্ভ’ ফ্রয়েডীয় প্রতীকীবাদ ও ইকো-ফেমিনিজম নির্ভর হাজার বছরের প্রাচীন বাংলার আখ্যান। যা মহামতি অতিশ দীপঙ্করের জীবনকে কেন্দ্র বাংলার বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহাসিক পটভূমিকে উপন্যাস আকারে পাঠকের সামনে উপস্থাপনের একটি অভিনব প্রয়াস। এটি সত্যি প্রশংসাযোগ্য কাজ। এটি লিখেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ফোকলোর গবেষক কনক আমিরুল ইসলাম। উত্তরণ প্রকাশ থেকে ২০২২ সালে উপন্যাসটি একুশে বই মেলায় আসে।
সম্প্রতি অনলাইন নিউজ পোর্টাল রাইজিংবিডি তরুণদের লেখার সুযোগ দিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তখনই ভাবলাম, ‘চন্দ্রগর্ভ’ উপন্যাস নিয়ে কিছু লেখা উচিৎ।
চন্দ্রগর্ভকে অনেকটা ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস বলা যায়। হাজার বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া বরেন্দ্রী-বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক উত্থান-পতনের পটভূমিকে সামনে রেখে চন্দ্রগর্ভের আখ্যান রচিত। বর্তমান উপন্যাসে বাঙলা কেবলই একটি ভৌগোলিক এলাকা নয়; কখনো নারী, কখনো প্রকৃতি কিংবা আপন মর্যাদায় টিকে থাকার শক্তি, প্রেরণা ও অস্তিত্ব।
উপন্যাসটি মূলত অতীশ দীপংকরের জীবনকে কেন্দ্র করে লেখা। অতীশ দীপংকরের ত্যাগী, সংগ্রামী ও সন্ন্যাসী জীবনের বর্ণনা চন্দ্রগর্ভ উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। ‘চন্দ্রগর্ভ’ মহামতি অতীশ দীপঙ্করের পারিবারিক নাম। তবে উপন্যাসটি জীবনীভিত্তিক নয়। ফ্রয়েডীয় প্রতীকীবাদ এবং ইকো-ফেমিনিজমের ধারণা সামনে রেখে তাঁর সময়কে ধরে তৎকালীন বাঙলা, বিশেষত পাল সাম্রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা থেকে সেনদের জাগরণ, দশম শতাব্দীর শেষ দুই দশক থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের বাংলার শিক্ষা, সমাজ, অর্থনীতি, বহির্বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতি, জনজীবন, দ্বন্দ্ব ও প্রেম -এর উপজীব্য।
শ্রীজ্ঞানের জন্ম, শৈশব, শিক্ষা, বিকাশ থেকে সত্যসূর্য হয়ে ওঠা ও তিব্বত যাত্রা পর্যন্ত এর জমিন। বাঙলার বরেন্দ্র ভূমির পাশাপাশি কখনো এসেছে রাঢ়, বঙ্গ, কখনো বর্ধমান, মেদিনীপুর, ত্রিপুরা, বিহার, নালন্দা, মগধ, পাটালিপুত্র কিংবা নেপালের কথা। পাল সাম্রাজ্যের কথা বলতে গিয়ে এসেছে কৌম সমাজের মানবিক জীবন, ধর্মাচার ও প্রেমের দ্রোহ এবং মৌর্য ও গুপ্তযুগের ভাস্কর্য-শিল্পসাধনা প্রসঙ্গ। বাংলার বিক্রমশীল বিহার হয়ে, রামাবতী, পুণ্ড্রবর্ধন থেকে সোমপুর বিহার, তরাই অঞ্চল হয়ে হিমালয়ের কাছে ছুটে চলে এর চরিত্রসমূহ।
এখানে পর্যায়ক্রমে উঠে এসেছে তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থাও। ‘চন্দ্রগর্ভ’ পাঠের মাধ্যমে পাঠক যেমন সেই সময়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থা জানতে পারবে, ঠিক তেমনি জানতে পারবে আবহমানকালের সাহিত্য সংস্কৃতি, নারী পুরুষের সম্পর্ক ও সম্পর্কের টানা পোড়েন প্রভৃতি বিষয়ে। একজন পাঠক একুশ শতকে দাঁড়িয়েও হারিয়ে যাবে হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস সমৃদ্ধ দিনগুলোতে। এটি পড়তে পড়তে মনে হবে সেই সময়ের ঘটনা প্রবাহ যেন চোখের সামনেই ঘটে যাচ্ছে।
উপন্যাসে ষোল বছরের কিশোরী পদ্মাবতীকে নায়িকা চরিত্রে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে তার শরীরবৃত্তীয় ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা লেখক এখানে অঙ্কন করেছেন। মানুষ যে প্রকৃতিরই অংশ, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে নিবিড় সম্পর্ক সেটা চমৎকারভাবে ঔপন্যাসিক ফুটিয়ে তুলেছেন।
ঘটনাচক্রে অনেক চরিত্রই উপন্যাসে উঠে এসেছে। অতীশ দীপংকর ছাড়াও একে একে উঠে এসেছে রাজাকুমার সত্যানন্দ, সত্যানন্দের বন্ধু উদয়াচল, বিনোদিনী, পদ্মাবতী, মালিনী এই চরিত্রগুলো। যার মাধ্যমে হাজার বছরের বাংলার অবস্থা ও সংস্কৃতিকে পরোক্ষভাবে দেখার সুযোগ করে দেয়।
উপন্যাসের অন্যতম বিশেষত্ব রাজকুমার ও পদ্মাবতীর প্রেমের রসায়নে পাঠককে আচ্ছন্ন রাখা। তবে উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে কখনো মনে হয়েছে অল্প কথায় অনেক চরিত্রের প্রবেশ ঘটানো হয়েছে। এতে সব চরিত্র পূর্ণাঙ্গ লাভ করতে পারেনি। চরিত্রগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাও হয়ে উঠেনি। উপন্যাসটি আরেকটু বড় করে চরিত্রগুলো অস্তিত্ববাদী করে তুললে উপন্যাসটা আরও সুপাঠ্য হয়ে উঠত সম্ভবত।
আরেকটা বিষয় না বললেই নয়, সেটা হচ্ছে- লেখার ভঙ্গিমা ও ভাষার প্রয়োগ। একুশ শতকে এসেও মনে হয় উনিশ শতকের বই পড়ছি। অনেকটা বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের কথা মনে হচ্ছিলো। খুব ছোটবেলায় বঙ্কিম চন্দ্রের উপন্যাস পড়তে গিয়ে ভাষার কাঠিন্যে উপন্যাসের গল্পই ভুলে যেতাম, যা 'চন্দ্রগর্ভ' পড়তে গিয়েও কিছুটা মনে হয়েছে। তবে উপন্যাসের প্রেক্ষাপট, চরিত্র বর্ণনা, উচ্চমার্গীয় শব্দচয়ন ও দর্শনভিত্তিক আলোচনা সার্থক উপন্যাসের দাবি রাখে।
আশাকরি, পণ্ডিত অতীশ দীপংকরের জীবনভিত্তিক এই উপন্যাসের মাধ্যমে একজন পাঠক প্রাচীন বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে ও শিখতে পারবে।
পরিশেষে উপন্যাসের সাফল্য কামনা করছি।
(লেখক: শিক্ষার্থী, উর্দু ভাষা ও সাহিত্য, মাস্টার্স, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।)