ক্যাম্পাস

নির্বাচনে নারী প্রার্থী ও আমাদের মানসিকতা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কড়া নাড়ছে দোরগোড়ায়। সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে শিরিন শারমিন চৌধুরি, ড. দিপু মনিসহ খুব নগন্য সংখ্যক নারী প্রার্থী আছেন, যারা জনগনের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতে চান। জাতীয় সংসদ (সংরক্ষিত মহিলা আসন) নির্বাচন আইন, ২০০৪ অনুসারে, অবশিষ্ট ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত।

১৯৭২ সালে মুলত নারী সংরক্ষিত আসনের এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিলো। যার প্রেক্ষাপট ছিলো নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারছে কি?

ক্ষমতায়ন বলতে একজন মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার অংশগ্রহণ এবং সেই সঙ্গে নিজের ও সমাজের মান উন্নয়ন বোঝায়। এর জন্য সেই ব্যক্তির নিজের  চিন্তা-চেতনা ও কর্মের সক্রিয়তা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে তার সিদ্ধান্ত ও মতামত গ্রহণ করার মত উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদরা খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন না। তবে সংরক্ষিত আসনের সাংসদদের কার্যপরিধির ব্যাপ্তি বা দায়িত্বের বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে আলাদাভাবে উল্লেখ নেই।’ (সুত্রঃ দৈনিক যায়যায়দিন, ১৬ জানুয়ারি, ২০১৯)।

নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে, সংসদের নারীর উপস্থিতি বেশি রাখার জন্য অর্ধশতটি সংরক্ষিত আসন যথেষ্ট নয়। এই সদস্যদের কাজের গুণগতমান বৃদ্ধি করতে না পারলে শুধু সংখ্যা দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন হবে না। সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্যদের জবাবদিহিতাসহ কাজের মনিটরিং করা জরুরি। তাছাড়া আসন সংরক্ষিত থাকায় নারীদের মাঝে প্রতিযোগিতার প্রবণতা থাকে না বললেই চলে। কারণ, তারা জানে, দিন শেষে কিছু আসন তাদের জন্য সংরক্ষিত আছে। এর পরিবর্তে যদি সংরক্ষিত আসন না রেখে সবাইকে প্রতিযোগিতার মাঠে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হত, তাহলে এই নারীরাও নিজেদের আসন রক্ষার স্বার্থে নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করত এবং জনগণের জন্য কার্যকরী অবদান রাখার চেষ্টা করত।

অন্যদিকে, রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীদের কাজ করার কি উপযুক্ত পরিবেশ আছে? যারা প্রতিযোগিতার মাঠে আছেন তাদেরও নানারকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত । আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বা কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আমরা শুনতে পেয়েছি নানা বিচিত্র প্রচারণা, নানারকম স্লোগান। তেমন একটি পরিচিত স্লোগান হলো, ‘সকাল বিকাল রাত্রিবেলা, অমুক ভাই/আপার দরজা খোলা।’

খুব সহজভাবে এবং মার্জিতভাবে এর মানে হলো, অমুক ভাই বা বোন যদি জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন, তবে সকাল, দুপুর বা রাত যেকোনো সময় তিনি সাধারণ মানুষের জন্য তার সহযোগিতার দরজা খোলা রাখবেন । ২৪ ঘণ্টায়ই যেকোনো সময় তাকে পাওয়া যাবে জনগণের পাশে, যা খুব সুন্দর এবং প্রত্যাশিত প্রতিশ্রুতি। আমরা কিন্তু একজন প্রতিনিধির কাছে এটাই চাই। পার্থক্যটা হলো, যখন বলা হচ্ছে অমুক ভাইয়ের দরজা খোলা, তখন আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু যখন বলা হচ্ছে অমুক আপার দরজা খোলা, তখন আমাদের সমাজের কিছু বিকৃত মস্তিষ্ক অত্যন্ত অশালীনভাবে একে উপস্থাপন করে বিনোদনের খোরাক করে ফেলছেন। মহিলা জনপ্রতিনিধি যে, ২৪ ঘণ্টাই জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকতে পারে, সেটা আমরা মানতেই পারছি না। বরং তাকে বিশ্লেষন করা হচ্ছে অন্যভাবে।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘ট্রাক’ মার্কায় অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী লড়ছেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও সমালোচিত হলেন মাহিয়া মাহি, কেননা তিনি একজন নারী। যখন একজন প্রার্থীকে শুধু তার লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে এতটা ট্রলের শিকার হতে হয়, তখন সাধারণ নারীরা এই স্থানে আসার সাহস পাবে না, এটাই স্বাভাবিক।

শুধু রাজনীতি নয়, প্রায় সব অঙ্গনে সুযোগ পেলেই নারীকে নিয়ে করা হচ্ছে অযাচিত কিছু মন্তব্য। ক্লাসের সর্বোচ্চ  নাম্বার পাওয়া কিংবা চাকরি ক্ষেত্রে উন্নতি হলে অনেক্ষেত্রেই আশেপাশের পুরুষ বন্ধু বা সহকর্মীটি সাফল্যের অন্য কোনো কারণ দেখাতে ছাড়ে না। 

এমন অনেক অদৃশ্য বাঁধা আছে নারীদের মাথার উপরে যা তার উঠে দাঁড়ানোটা কৌশলে আটকে দেয়। যতই নারী জাগরণ এর কথা বলি, সংরক্ষিত আসন দেই, এই গ্লাস সিলিং ভাংতে না পারলে রাজনীতিতে কখনোই নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে না।

রেশিও ৫০:৫০ আনতে হলে এই মানসিকতা পাল্টাতে হবে। নয়তো ওই কয়টা সংরক্ষিত আসনের কাঠের পুতুলই সই। নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন করতে হলে, নারী জনপ্রতিনিধিদের, তাদের নিজেদের দক্ষতা ও কাজের পরিধি বাড়াতে হবে।একই সঙ্গে নারীর কাজ করার সুন্দর পরিবেশ করে দিতে হবে। শুধু সংখ্যা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন আসবে না৷

লেখক: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।