শিক্ষক সমিতির পদে থাকা অবস্থায় বারবার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অস্থিতিশীল করার অভিযোগ উঠেছে অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের ও সহযোগী অধ্যাপক মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে। পূর্বের ধারাবাহিকতায় এবারও শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হয়েই উপাচার্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন তারা।
জানা গেছে, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কুবি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে জয়ের পর ওইদিন বিকেলে উপাচার্যকে ঘেরাও করে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন তারা। এছাড়া উপাচার্যকে ‘নব্য আলী জিন্নাহ’ বলেন সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান। পরে গত ৬ মার্চ উপাচার্যকে সবার সামনে ‘ডাস্টবিন’ সম্বোধন করে পদত্যাগ করতে বলেন।
এর আগেও সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মো. আলী আশরাফের সময়ে ২০১৭ সালের ১০ মার্চ অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৫তম সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসেবে সিন্ডিকেট সভায় যোগ দিতে আসেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান। এসময় ভিসি বাংলোর মূলফটকে ইউজিসি চেয়ারম্যানকে গাড়িসহ প্রবেশে বাধা দেন এবং তার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণে জড়িত ছিলেন মেহেদী হাসান। এ ঘটনায় তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আবু তাহের, সাধারণ সম্পাদক ও মার্কেটিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মেহেদী হাসানসহ তৎকালীন শিক্ষক সমিতির আরও সাত সদস্যকে ইউজিসির চিঠির প্রেক্ষিতে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।
ওই বছরের শেষ দিকে উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম এনে ইউজিসি বরাবর চিঠি দেয় তৎকালীন শিক্ষক সমিতি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতির বিচারসহ ১৪ দফা দাবিতে ১৫ অক্টোবর উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে উপাচার্য ওই দাবি পূরণ করেননি অভিযোগ এনে পরদিনই (১৬ অক্টোবর) উপাচার্যের দপ্তরে তালা দেন তারা। প্রায় তিন সপ্তাহ উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে না আসায় অস্থিতিশীলতা শুরু হয় একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি একটি সিমেন্ট কোম্পানিতেও চাকরি করার ঘটনা রয়েছে সহযোগী অধ্যাপক মেহেদী হাসানের কর্মজীবনে। বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সিমেন্ট কোম্পানি থেকে আয়ের এক-চতুর্থাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা দেওয়ার কথা বললেও এখন পর্যন্ত তিনি জমা দেননি।
সর্বশেষ ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যান তিনি। এক বছরে নির্ধারিত সংখ্যক কোর্স শেষ করতে না পারায় বাতিল করা হয় তার ফেলোশিপ। সম্প্রতি বিষয়টি গণমাধ্যমে আসলে জানা যায়, তিনি দেড় বছরের মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য প্রথমে দুই বছরের ছুটি ভোগ করেন। পরবর্তীতে বিনা বেতনে এক বছরের ছুটি ভোগ করেন। সর্বশেষ ১০ মাস ২৬ দিনের অসাধারণ ছুটি কাটান তিনি। তিনি আরও ছুটি চাইলে কুবি সিন্ডিকেট তা নাকচ করে। এরপর তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক জানান, শিক্ষক সমিতিকে বারবার উপাচার্য পতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় সাধারণ শিক্ষকদের সেন্টিমেন্ট নিয়ে। এবারও ব্যতিক্রম নয়। নানা কাজে বিতর্কিতরা এবার সবাই এক ছাদের নিচে এসেছে। মেহেদী হাসানকে যদি ছুটি দিয়ে দেওয়া হয় তিনি আর শিক্ষক সমিতি নিয়ে ভাববেন না। তখন আর আন্দোলন, সংগ্রাম হবে না। সবাই সবার ব্যক্তিস্বার্থ উদ্বারের জন্য এক হয়েছে।'
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন বলেন, 'আমরা মাস্টার্সের জন্য দুই বছর শিক্ষা ছুটি দিয়ে থাকি। তারপরও তার সমস্যার কথা বিবেচনা করে আরও প্রায় দুই বছর ছুটি দেওয়া হয়। কিন্তু এখন উনি আরও যে ছুটি চাচ্ছেন, তা নিয়মানুযায়ী দেওয়া যায় না বলেই আমি সিন্ডিকেটে পেশ করি। সিন্ডিকেট তা বাতিল করে দিলে আমার এখানে কিছু করার থাকে না। এজন্য সে এখন আমার নামে আজেবাজে কথা বলে বেড়ায়।'
এদিকে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু তাহেরের নামেও আছে নানা দুর্নীতির অভিযোগ ও বিতর্ক। জানা গেছে, ২০১১ সালে ৪৯ লাখ ৬৯ হাজার টাকা ব্যয়ে ৮.৪ কিলোওয়াটের একটি সোলার প্যানেল স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন তৎকালীন রেজিস্ট্রার ড. আবু তাহের। ওই বছরই সোলার প্যানেলটি অকেজো হয়ে পড়লেও তিনি তাদের দিয়ে সেটা মেরামত না করিয়েই বাকি অর্থ দিয়ে দেন। তখনই বাংলাদেশ অল্টারনেটিভ অ্যানার্জি সিস্টেম লিমিটেড নামে নিম্নমানের একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে এ প্রকল্পের সিংহভাগ টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ ওঠে। সরেজমিনে অভিযান চালিয়ে প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে বলে ২০২৩ সালে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছিলেন দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক।
এছাড়াও ২০২২ সালের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে ১১ মার্চ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে সেনাবাহিনীর পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আলী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন রেজিস্ট্রার ড. মো. আবু তাহের। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামানের। কিন্তু দুর্নীতি করতে কোষাধ্যক্ষকে এই প্রকল্পের বাইরে রাখতে রেজিস্ট্রার নিজেই আইন বহির্ভূতভাবে এ স্বাক্ষর করেন বলে তখন অভিযোগ করছিলেন সংশ্লিষ্টরা।
রেজিস্ট্রার থাকাকালে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা সামনে আসে। পছন্দের কর্মকর্তা-কর্মচারী, নিজ কোরামের শিক্ষকদের পদোন্নতি দ্রুত দিলেও অপছন্দের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতিতে গড়িমসি করতেন। গত ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষে ড. আবু তাহের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। সে বছর ইউনিটটির ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয় বলে অভিযোগ উঠেছিল।
এ বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, 'সে সময় ওই উপাচার্য যেসব ভবনগুলো প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনায় শুরু করেছিলেন, তা তো ৬-৭ বছরেও হস্তান্তর হচ্ছে না। তখন সেগুলো নিয়েই তো কথা বলেছিলাম। এদিকে ওইদিন (৬ মার্চ) উপাচার্য সবার সামনে শিক্ষকদের বলেন তারা রিসার্চ করতে পারেন না। এটা তো শিক্ষকদের জন্য চূড়ান্ত অপমান। এসব করলে তো দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান নষ্ট হবে। আর ২০১৭ সালে ও এবারের কমিটিতে হতে পারে আমি ও তাহের স্যার আছি, সেটা তো গণতান্ত্রিকভাবেই নির্বাচিত হয়েছি। পূর্বের ঘটনা আর এবারের ঘটনা আলাদা বিষয়। আগেরবারও আমি আর তাহের স্যার ছিলাম। এটা হতেই পারে।'
সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, ‘আগের ঘটনার সঙ্গে এ ঘটনা মিলালে তো হবে না। উপাচার্য অনিয়ম, দুর্নীতি করলে আমরা সচেতন শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ তো জানাবই। আমরা সাধারণ শিক্ষকদের ম্যান্ডেট নিয়েই এসেছি। এক বছর কমিটি না থাকায় তাদের যে দাবিগুলো বলতে পারছিলেন না, সেটা এখন আমাদের মাধ্যমে জানাচ্ছেন। এখন উপাচার্য যদি এসব অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করেন তাহলে আমরা তার সাথে থাকব।'