ক্যাম্পাস

আত্মহত্যার কারণ ও সমাধানে যা ভাবছেন শিক্ষার্থীরা

জীবন সৃষ্টিশীল এক অধ্যায়। আর এই চলমান অধ্যায়কে স্বেচ্ছায় শেষ করে দেন অনেকেই। চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্বে নির্লিপ্ত হয়ে যায় অনেক সৃষ্টিশীল জীবন। এই স্বেচ্ছামৃত্যুর নাম দেওয়া হয়েছে 'আত্মহত্যা'। সম্প্রতি শিক্ষিত সমাজে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে আত্মহত্যার পরিমাণ। এর কারণ ও সমাধান নিয়ে নিজের অভিমত তুলে ধরেছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

ঘুণে ধরা আর্থসামাজিক অবস্থা দায়ী

শিক্ষার্থীদের ভেতর আত্মহত্যার প্রবণতা হুট করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ হলো 'রাজনীতি'। রাজনৈতিকভাবে একটা সমাজ যখন বিকল হয়ে থাকে এবং একই সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে যেখানে দুঃশাসন বহমান থাকে, সে ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী মানসিকভাবে অকেজো হয়ে যায়। সেখানে ছেলে-মেয়েরা ইতিবাচক কোনো কাজ খুঁজে পান না। ফলে নেতিবাচকতা পদে পদে। সেখানে এই ভয়াবহ ম্যাসাকার হবেই, যা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এক্ষেত্রে ঘুণে ধরা আর্থসামাজিক অবস্থা যথেষ্ট দায়ী। একজন শিক্ষার্থী সে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে জ্ঞানচর্চার জন্য, অথচ এসেই জড়িয়ে যাচ্ছেন কি করলে উপার্জন বাড়বে, সে রাস্তায়। শুরু হচ্ছে চাকরির প্রতিযোগিতা।

আত্মহত্যা রোধে ধর্মীয় মূল্যবোধ একটা বড় অবস্থান তৈরি করতে পারে। এতে মানুষ মানবিক থেকে আরও মানবিক হয়ে উঠবে। তবে শুধু ধর্মীয় মূল্যবোধ দিয়ে কার্যসম্পাদন সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে প্রাচ্যের ইতিবাচক দর্শন নিয়ে কাজ করতে হবে। যেখানে মানুষকে বাঁচতে শেখানো হয়। কিভাবে জীবন উদযাপন করা যায়, জীবনকে ভালোবাসতে হয়, ইতিবাচকতার চাদরে চলা যায় ইত্যাদি শেখানো হয়।  (লেখক: মীর হাবিব আল মানজুর, শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।)

বন্ধুবান্ধবই হতে পারে ঈশ্বরদূত

শিক্ষার্থীদের মধ্যে হঠাৎ আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের মধ্যে অন্যতম আধুনিক শিক্ষার অভাব। দেশে প্রচলিত শিক্ষাক্রম যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্মার্ট হয়নি। যুগের পর যুগ চলতে থাকা এই আদিম শিক্ষানীতি ২১ শতকে বড্ড বেমানান। চিত্ত বিনোদনহীন একঘেয়েমি একাডেমিক শিক্ষার চাপ, সঙ্গে ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রের দুশ্চিন্তা, যা শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ। পাশাপাশি প্রেমে বিচ্ছেদ, পারিবারিক অশান্তি, আর্থিক অভাব ও শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যাকে ত্বরান্বিত করছে। আত্মহত্যার মুখ্য কারণ মানসিক হতাশা।

মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে অপরিহার্য অর্থ। অর্থের অভাবে মৌলিক অধিকার অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। নিম্ন মধ্যবিত্তের এ দেশে আর্থ সামাজিক অবস্থা শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূমিকা রাখে। একজন শিক্ষার্থীর ব্যাক্তিজীবনের অনেক কিছুই তার পরিবারকে জানাতে বিব্রত বোধ করে। এসময় তার সব থেকে কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পারে একজন সহপাঠী বা বন্ধু। হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত একজন মানুষের জীবনে জাদুকরি টনিক হিসাবে আশার আলো ফোটাতে পারে বন্ধু-বান্ধব। হতাশায় আত্মহত্যার পথে আগানো মানুষকে আবারো তার পূর্বের ট্র্যাকে ফেরাতে বন্ধুবান্ধবই হতে পারে ঈশ্বরদূত। আত্মহত্যা কি আদৌও কোনো সমাধান হতে পারে! জীবন একটাই, এ জীবনে দুঃখ ছাড়া সুখের কোন মূল্য নেই। সাহস নিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে অনুকুল পরিস্থিতি তৈরি করাই আসল সার্থ্যকতা। ধৈর্য ধরতে হবে, পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ জরুরী, আর আধার শেষে আলো আসবেই। (লেখক: সৌমিক আহমেদ, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।)

শত বছরের ধারাকে পরিবর্তন করাটাই নেতিবাচক

এমন একটা প্রজন্মে আমরা বাস করছি, যারা রাতে জেগে থাকি, দিনের বড় অংশটুকু ঘুমিয়ে কাটাই। রাতে হালকা খাবারের বদলে ক্যাফেটেরিয়ার উচ্চ ক্যালোরির 'প্ল্যাটার' বেশি পছন্দ করি। অথচ সকালে ভালো একটা নাস্তা করার বদলে কিছু না খেয়ে কাটিয়ে দেওয়াতেই অভ্যস্ত। অর্থাৎ মোটামুটি মানুষের জীবনের শত বছরের ধারাটাকেই হুট করে বদলে দিতে শুরু করেছে যে প্রজন্ম, তার কর্মফল যে নেতিবাচক হবে; এটাই কি অনুমিত নয়!

বিগত বছরে দেশে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা নথিভুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই স্কুলপড়ুয়া। অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের আত্মহননের পেছনে মোটা দাগে যে কারণগুলো জড়িত সেগুলো হলো- পড়াশোনায় ব্যক্তিগত বা পরিবারের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতা, প্রেমবিষয়ক জটিলতা, বয়ঃসন্ধিকালীন আবেগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা আর ক্ষেত্রবিশেষে পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন। যেসব কারণকে একটা জেনারেশন থোড়াই কেয়ার করেছেন, সেই একই কারণে আজকের জেনারেশন আত্মহত্যা করছেন।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা উঠতি বয়সের উচ্চাভিলাষী মনকে সামাল দেওয়া যে এখন অনেক উচ্চশিক্ষিত বাবা-মায়ের জন্যও কষ্টসাধ্য বিষয়। আত্মহত্যা প্রতিরোধের প্রশ্নে বর্তমানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা মূলক শিক্ষা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। ভয় দেখিয়ে সন্তানকে শেখানোর যুগ পার হয়েছে, এখন বোঝানোর মাধ্যমে বাস্তবতা তুলে ধরার প্রয়াস নেওয়ার সময়। মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। সকলের সুচেষ্টা যদি থাকে, তবেই বর্তমানের আলোচিত এই ব্যাধি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। (লেখক: গালিব মাহমুদ সৌম্য, শিক্ষার্থী, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ।)

নজর দিতে হবে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে

আত্মহত্যার জন্য মানসিক বিষণ্নতা, একাকিত্ব, বঞ্চনা, হতাশা দায়ী। সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মান-অভিমানের কারণে আত্মহত্যা করছে শিক্ষার্থীরা। আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে সহপাঠীদের ভূমিকা কার্যকারী। কোন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পরিবার থেকে বিছিন্ন থাকলেও সহপাঠীদের সান্নিধ্যে থাকে বেশি সময়। তাই তারা বুঝতে পারে, কোন বন্ধুর মধ্যে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক কি চলছে। সহপাঠীরা চাইলে সঙ্গ, সাহস, বুদ্ধি,পরামর্শ দিয়ে মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে। পড়ানোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিতে হবে। কেউ অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে থাকলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এটা শিক্ষকদের যেমন দায়িত্ব, তেমনি পরিবারের সদস্যদেরও দায়িত্ব। নেতিবাচক ভাবনা থেকে দূরে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি করা, মানসিক বিকাশ এবং তাদের সহানুভূতির সঙ্গে শুনতে হবে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার পাশাপাশি আচার-আচরণ মূল্যায়ন করতে হবে। (লেখক: শাহীন আলম, শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।)