‘আলাউদ্দিন সালাউদ্দিন রাইত পোহাইলে ঈদের দিন আট মুইনা বস্তা, চেয়ারম্যানের নাস্তা!’
কেউটে সাপের মতো চোখ তুলে কুতকুত করে যতই এগিয়ে যাচ্ছি ততই মনে পড়ছে শৈশবের কথা। তিনু, বিন্তি, শাইম্মা আর আমি মিলে দলবেঁধে এরকম কতই না ছড়া আওড়াতাম চান্নী রাতে। আগামীকাল চান্নী রাত। চাঁদ রাতকে আমরা বলি চান্নী রাত। অথচ এখনো জোগাড় করতে পারলাম না ট্রেনের টিকিট। ছয় ঘণ্টা হয়ে গেছে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, অথচ পেলাম না টিকিটের দেখা। হঠাৎ মায়ের ফোন-
- বাবা কবে আসবি বাসায়?
-কালকেই চলে আসব মা। চিন্তা করো না।
-আচ্ছা, সাবধানে আসিস বাবা।
মা, ভাইয়া কি ঈদে এবারও লাল রঙের তাঁত পাখি ফ্রক আনবে আমার জন্য? হ্যাঁ রে, মিষ্টি; নিয়ে আসবে ভাইয়া। মায়ের সাথে কথা বলার সময় আড়াল থেকে ফোনে মিষ্টির গলাটা শুনে মনটা খুব ভালো হয়ে গেলো।
-আমার মিষ্টি বোনটা কি করে?
-চারুর সাথে ধাপ্পা খেলি ভাইয়া। জানো ভাইয়া চারু, সুমি, রুমিরা ঈদের জামা কিনে ফেলেছে। কিন্তু আমার জামা এখনো আসেনি যে!
-আসবে বৈনা। এইতো ভাইয়া আসবে কালকে। অনেকগুলো ফ্রক আনবে তোমার জন্য, সাথে তোমার প্রিয় টিয়ানা পুতুলও।
হঠাৎই পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলো-সামনে আগান ভাই। সামনে এগিয়ে যাচ্ছি ক্রমশই। বিশাল বড় লাইন। কিন্তু টিকিটের দেখা নাই। ঘণ্টা দুয়েক পর শুনতে পেলাম টিকিট শেষ, আর কোনো টিকিট নেই।
একেবারে যেন অরণ্যে দিশেহারা হয়ে পড়লাম! বাসে যাওয়ার মতো টাকাও আমার কাছে নেই। ময়মনসিংহ থেকে নারায়ণগঞ্জের বন্দরে বাসে যেতে লাগবে ৫৬০ টাকা কিন্তু আমার কাছে আছে মাত্র দুইশ টাকা। আর শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় ট্রেনে স্ট্যান্ডিং যাওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব না। মনটা ভীষণই খারাপ হয়ে গেলো। এর মধ্যে আবার ঝড়ো বৃষ্টি। চলে যাচ্ছে যে যার মতো। কিন্তু খালি হাতে আমি যাব কোথায়?
বাবা নেই। মা আর ছোট বোনটা যে তীর্থের কাকের মতো বসে আছে আমার জন্য। টিউশনির সব টাকাই তো সেমাই আর জামা কিনতে গিয়ে শেষ হয়ে গেল! বাকি ২০০ টাকায় করি কি! মনের অজান্তেই বৃষ্টির সাথে চোখের কোণে গড়িয়ে পড়লো আমার মনের বৃষ্টি। আচমকা পেছনে কেউ হাত দিতেই ভাবলাম ছিনতাইকারী কি-না! কিন্তু না এ দেখি আমার শৈশবের বন্ধু শাইম্মা মানে শামীম। ওকে দেখে একদমই বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
-তুই এখানে?
-আর তুই বৃষ্টিতে কী করিস? আগে ছাতার নিচে আয়। একটা কাজে ময়মনসিংহ আসছিলাম। তোকে কতবার যে ফোন দিলাম, ফোনটাও তো বন্ধ।
-হ্যাঁ বন্ধু, ঐ ফোনটা হারিয়ে গেছে রে।
-তো টিকিট পাইলি?
-না।
-সমস্যা নেই। আমার কাছে দুটো আছে। একসাথে আমরা বাড়ি যাব...
এ কথা শুনে কতটাই না আহ্লাদে আটখান হলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। পরদিন দুপুরের ট্রেনে ঠিক সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরতেই দেখি মিষ্টি উঠোনে বসে ধাপ্পা খেলছে। আর দীর্ঘ চার মাস পর মাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালাম। মায়ের চোখে পানি, ঠিক জলরঙের ঢেউের মতো বইছে দুই চোখ থেকে। বোনের হাতে লাল ফ্রক আর মায়ের হাতে কাপড়টা দিয়ে যতই এগুতে লাগলাম, চাঁদনী রাতের সুবঙ্কিম চাঁদ ততই উচ্চস্বরে গাইতে লাগলো-‘ছেলেকে পাওয়ার ভালোবাসায় দুঃখ হয়ে যায় জলরঙের ঢেউ, বোন ভাই আর মায়ের ভালোবাসার এমন বন্ধন কখনো দেখেছো কি কেউ!’
-শিক্ষার্থী, পশুপালন অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন-