ক্যাম্পাস

‘আম্মু এখন অভিমান করতেও জানে’

আম্মুও সারপ্রাইজ পেতে পছন্দ করেন। ফুল উপহার পেলে তার বেশি ভালো লাগে। ঘুরতে যেতে কিংবা রেস্তোরাঁয় খেতে যেতে ভালোবাসেন, তা আমার জানা ছিল না। কারণ ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি আম্মু কখনোই কারো কাছে কোনোকিছুর আবদার করেননি। আম্মু কখনোই কোথাও ঘুরতে যেতেন না। এমনকি বাসায় ভালোমন্দ রান্না হলে তা না খেয়ে আমাদের জন্য রেখে দিতেন।

২০১৮ সালের মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার ছিল ১৩ তারিখ। স্কুল থেকে ফিরে একটি গোলাপ ও চকলেটের সঙ্গে একটি চিরকুট আম্মুকে দিলাম।

‘শুধু একটি মুখের হাসি পৃথিবীর হাজার দুঃখ দূর করে। একটি মুখের কথা হাজার কষ্টের মাঝে এক রাশ সুখ হয়ে দাঁড়ায়। অন্ধকারের মধ্যেও হাসিমাখা মুখটি ভেসে ওঠে। সামনে এসে দাঁড়ালে মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটি আমি দেখতে পাচ্ছি। আর যখন পাশে না থাকে, বেঁচে থাকার আশা খুঁজে পাই না। এতো মানুষের মাঝেও পৃথিবীটা শূন্য লাগে। সুখের মাঝেও হাজার কষ্ট বয়ে আনে।’

মা এই ছোট্ট একটি শব্দ, শুধু একজন মানুষ। কিন্তু তার উপস্থিতি সব বদলে দেয়। এ পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসি আমার মা’কে। পৃথিবীর সব মা’ই বেস্ট। কিন্তু আমার কাছে আমার মা ওয়ার্ল্ড বেস্ট।'

আম্মু বরাবরের মতোই তার স্নিগ্ধ হাসির সঙ্গে বললেন, ‘এসবের কি দরকার ছিল।’ তারপর আমার সামনে দাঁড়িয়ে যখন তিনি চিরকুটটা পড়লেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, তার মায়াবী চোখ দুটো ছলছল করছিল। তিনি আমাকে আর তেমন কিছু না বললেও আমি বুঝেছিলাম, তিনি কতটা খুশি হয়েছিলেন। 

গত বছর আমার গুচ্ছে পরীক্ষা ছিল। সিট পড়েছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি নিজে যেতে পারি, তবুও আম্মু এসে বলছে সে আমাকে নিয়ে যাবে এবং আসার পথে একটু ঘুরাঘুরি করে আসবে। আমি যখন পরীক্ষার হলে গেলাম আম্মু আমার জন্য বাইরে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছিলেন। পরীক্ষা শেষে মুখে একরাশ ঘনকালো মেঘ নিয়ে বাইরে বের হলাম।

‘পরীক্ষা ভালো হয়নি?’ আম্মু জিজ্ঞেস করলেন। আমি মন খারাপ করে উত্তর দিলাম আশানুরূপ হয়নি। মানে খারাপই হয়েছে বলা যায়। আম্মু কখনোই আমাকে পড়াশোনা নিয়ে বকাঝকা করতেন না, সুতরাং সাধারণভাবেই বললেন, ‘সমস্যা নেই। পরীক্ষা দিয়েছো, এটাই যথেষ্ট।’  

সেখান থেকে বের হয়ে ঠিক করলাম শালবন বিহার যাবো, যেহেতু ভার্সিটির পাশেই এটা। দুজনের জন্য টিকেট আর আইসক্রিম কিনে ভিতরে ঢুকলাম। অমনি শুরু হয়ে গেলো বৃষ্টি। মনে হচ্ছিল, বৃষ্টি তার পানির সঙ্গে আম্মুর হাসিগুলোও ধুয়ে মুছে নিয়ে যাচ্ছে। তবে কি আর করার দ্রুত বেগে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলো। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর আম্মুকে নিয়ে গেলাম তার পছন্দ অনুযায়ী রেস্টুরেন্টে এবং বিলটা আমি পে করলাম। যদিও তিনি চাইলে বিল দিতে পারতেন। তবুও আমি দেয়াতে তিনি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। 

আগে রাস্তায় পাড়ি দেওয়ার সময় আমি আম্মুর হাত ধরে রাখতাম। আর এখন আম্মু আমার হাত ধরে। আপাতত দৃষ্টিতে বিষয়টা একই মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এক নয়। 

সবার মতোই আম্মু আমার হাতের কাজ খুব পছন্দ করেন। আম্মু আবদার করেছিলেন, তাকে যেন একটা হ্যান্ডপেইন্ট শাড়ি করে দিই। সুন্দর একটা নীল রঙের শাড়ী কিনেছিলাম পেইন্ট করে দিবো বলে। আজ দু’বছর হলো সেটা আলমারিতে পড়ে আছে। বিভিন্ন ব্যস্ততায় তা আর করা হয়নি। সেদিন একমুখ অভিমান নিয়ে বলছেন, ‘আমার শাড়িটা তো এখনো করে দিলি না!’ সে কথায় লজ্জিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু খুশিও হয়েছিলাম বটে। কারণ, আম্মু এখন অভিমান করতেও জানে! 

লেখক: শিক্ষার্থী, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা বিভাগ, সেশন ২০২২-২৩, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়