ক্যাম্পাস

ভারত‌নির্ভরশীলতা কমাতে গিয়ে সংকট বাড়তে পারে মালদ্বীপের 

ভার‌তনির্ভরশীলতা কমাতে গিয়ে মালদ্বীপের আর্থিক সং‌কটে পড়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা, ঋণ বৃ‌দ্ধিসহ অন্যান্য দ্বিপা‌ক্ষিক বা‌ণিজ্যের সংকটও তৈ‌রি হতে পারে। সে বিষয়ে আলোচনা করার আগে দ্বীপ রাষ্ট্র‌টি কীভাবে ভারতনির্ভরশীল হলো এবং ভারতও কীভাবে তাদের ‌বি‌ভিন্নভাবে সাহায্য করাসহ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপে সুযোগ পেল, সে‌টিও জেনে নেওয়া যাক।

১৯৬৫ সালে ব্রিটেনের কাছে থেকে স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন ইব্রাহিম নাসির। কিন্তু ১৯৭৮ সালে নাসিরকে সরিয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট হন মামুন আবদুল গায়ুম। তাকেও ক্ষমতা থেকে সরাতে ১৯৮০ ও ১৯৮৩, ১৯৮৮ সালে অভ্যুত্থান হয় মালদ্বীপে। তবে এরমধ্যে ১৯৮৮ সালের অভ্যুত্থানের সাথে ভারতের নাম জড়িয়ে আছে। ১৯৮৮ সালের ৩ নভেম্বর গায়ুমের ভারত সফরে যাওয়‌ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ তি‌নি সফর ব‌া‌তিল ঘোষণা করেন। তি‌নি আঁচ করতে পেরেছিলেন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে রাজনৈ‌তিক দলগুলো এক হয়েছে। যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আবদুল্লা লুতিফি। গায়ুম সরকারবিরোধী অভ্যুত্থান ঠেকাতে ভারতের নিকট সাহায্যের আবেদন করেন এবং ‘অপারেশন ক্যাকটাস’ পরিচালনা করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ফলে রাজিব গা‌ন্ধি সরকার‌ের সেনাবা‌হিনীর হাতে বন্দী হয় আবদুল্লা লুতিফি। এই অপারেশন ক্যাকটাসের মাধ্যমে ভারত মালদ্বীপে প্রভাব বিস্তার শুরু করে। তবে গায়ুম বিরোধীদের মধ্যে ভারতের প্র‌তি বিদ্বেষ রয়ে গেছে সে‌টি আমরা বি‌ভিন্ন সময়ে দেখতে পা‌চ্ছি। এরপরেও রাজনৈ‌তিক অস্থিরতা নিয়ে অনেক দশক পার করেছে মালদ্বীপ। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ দেশটিতে ৮৯ জন ভারতীয় সেনা মোতায়েন করার অন‌ুম‌তি দেন। এই সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে চীনের তৎপরতার ওপর নজরদারি করার পাশাপা‌শি আধিপত্য বিস্তারে এগিয়ে যায় ভা‌রত। প্রত্যক্ষভাবে ভারতীয় সাম‌রিক প্রভাব শুরু হয় মালদ্বীপে। ভারতীয় সাম‌রিক প্রভাব বৃ‌দ্ধি পেলেও নানাভাবে সহায়তাও করেছে ভারতীয় সেনা সদস্যরা।   কিন্তু ২০১৩ সালে ক্ষমতায় আসা প্রে‌সিডেন্ট ইয়া‌মিন আবদুল্লা চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক তৈ‌রি করেন। তৈ‌রি করেন চীনের দূতাবাস। ইয়ামিন দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে চীনের সাথে বর্ধিত সম্পৃক্ততার দিকে বৈদেশিক নীতির পরিবর্তন বাস্তবায়ন করেন। অনেকে মনে করেন ভারত ও পশ্চিমা প্রভাব ঠেকাতে তি‌নি চীনের সাথে সম্পর্ক তৈ‌রি করেন। এ ক্ষেত্রে তি‌নি ধর্মীয় সংঘবদ্ধতা তৈরি করে ইসলামকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করেছেন বলে কেউ কেউ মনে করেন। কেননা, মুস‌লিমপ্রধান দে‌শগু‌লো এরকম রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে প্রায়ই দে‌খি। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহ রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে পূর্বের ‘ভারত-প্রথম নীতি’ পুনরায় নিশ্চিত করেন এবং মালদ্বীপ ও ভারত তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে শক্তিশালী করেন।

কিন্তু ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান দিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন মোহাম্মদ মুইজ্জু। অর্থাৎ, দেশকে ভারতের প্রভাবমুক্ত করা ছিল তার রাজনৈ‌তিক স্লোগান। জয়ী হওয়ার পরই তি‌নি ৭৫ ভারতীয় সেনাকে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দেন। যা ইতোমধ্যে কার্যকরও হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, চীনপন্থি আবদল্লাহ ইয়া‌মিনের পথেই হাঁটছেন মুইজ্জু। 

রাষ্ট্রপ‌তি হওয়ার পর মুইজ্জু চীন সফর করেন। মুইজ্জু চীনকে তার দেশের ‘সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ উন্নয়ন অংশীদার’ বলে উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে তিনি চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্য গড়ে তোলার কথাও জানান। তিনি দাবি করেন, ভারত মালদ্বীপে একচেটিয়া বাণিজ্য করে যাচ্ছে। করোনা মহামারির আগে চীন মালদ্বীপের এক নম্বর বাজার ছিল। তাই তিনি চীনের নীতিনির্ধারকদের সেই হারানো অবস্থান পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ জোরালো করার পরামর্শ দেন। ধারণা করাই যাচ্ছে, মুইজ্জু সরকার ভারতনির্ভরশীলতা ক‌মিয়ে চীনের সাথে সখ্যতা তৈ‌রি করত‌ে যাচ্ছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভারতের উপর নির্ভরশীলতা কি আদৌ ক‌মাতে পারবে মালদ্বীপ? 

প‌রিসংখ্যান বলছে, মালদ্বীপের জন্য ভারতনির্ভরশীলতাই বে‌শি। কেননা দ্বীপ রাষ্ট্র‌টির জাতীয় আয়ের সিংহভাগ আসে পর্যটন খাত থেকে। আর এই পর্যটকদের বড় একটা অংশ ভারতীয়। মালদ্বীপে ভারতীয় দূতাবাসের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারত থেকে পর্যটক গেছেন ২ লাখ ৪১ হাজার, ২০২৩ সালে ২ লাখ (সূত্র: প্রথম আলো)। কাজেই মালদ্বীপ অবশ্যই চাইবে না ভারতীয় পর্যটক মুখ ফি‌রিয়ে নিক। তবে মুইজ্জুর ভারতবিরোধী স্লোগানের কারণে অনেক পর্যটক ইতোমধ্যে মালদ্বীপ ভ্রমণ বর্জন করেছে। এ ছাড়াও মালদ্বীপের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে ভারত দেশটিতে উন্নয়ন সহযোগিতা করে আসছে। ২০০৪ সালের সুনামিতেও ভারত ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে।

২০২১ সালের আগস্টে ভারত ও মালদ্বীপ গ্রেটার মালে কানেক্টিভিটি প্রজেক্টে স্বাক্ষর করে, যার অধীনে ভারত তাদের জন্য ৫০ কোটি ডলার দিয়েছিল। ২০২২ সালের মার্চ মাসে ভারত মালদ্বীপে দশটি উপকূলীয় রাডার সিস্টেম বসিয়েছে। মালদ্বীপের আদ্দু দ্বীপে একটি পুলিশ একাডেমি তৈরিতেও ভারত ওই দেশকে সহায়তা করেছিল।

সম্প্র‌তি এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (এএনআই) দেওয়া এক বিবৃ‌তি‌তে মালদ্বীপের সাবেক ডেপুটি স্পিকার এবং সাংসদ ইভা আবদুল্লাহ সে‌টি স্বীকার করেন। তি‌নি বলেন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাণিজ্য, পর্যটন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা ভারতের উপর নির্ভরশীল। আমরা ভারতের উপর কতটা নির্ভরশীল সেটা আমরা জানি। যখনই আমাদের প্রয়োজন হয়েছে, ভারতই প্রথমে সাহায্য করেছে। (তথ্যসূত্র: বি‌বিস‌ি)।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, যখন ভূ-রাজনী‌তির প্রসঙ্গ আসে, তখন পারস্পরিক কৃতজ্ঞতার বিষয়টির চেয়ে পারস্পরিক অসন্তোষের বিষয়টিই সাম‌নে বে‌শি চ‌লে আসে। 

গত এক দশক বা তার বেশি সময় ধরেই মালদ্বীপে ভারত-বিরোধী মনোভাব বাড়ছে। আর সেজন্যই মুইজ্জু ইন্ড‌িয়া আউট স্লোগান দেওয়ার পরেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়‌ী হয়েছেন। এতে স্পষ্ট যে, মালদ্বীপে ভারতবিরোধী সংখ্যা বেড়েছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ অভ্যন্তরীণ রাজনৈ‌তিক বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ। স্বাধীনতার পর মালদ্বীপের ‌নির্বা‌চিত রাষ্ট্রপ‌তিদের ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিরোধীদলগু‌লো বরাবরই তৎপর ছিল। আর সেখানে ছিল ভারতের হস্তক্ষেপ। তাই ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্ক কেমন হবে কিংবা চীন-ভারত ভারত মহাসাগরে রাজনীত‌ি কেমন হবে সে‌টি সময়ই বলে দেবে। তবে ভূ-রাজনী‌তিতে ভারত মহাসাগর এক নতুন অধ্যায়ের দ্বারপ্রান্তে, সেট‌ি বলাই যাচ্ছে।

এ ছাড়াও দ্বীপ রাষ্ট্র‌টি ভারত-চীন ভূ- রাজনী‌তির ক্ষেত্রে যেমন এগিয়ে, তে‌মনই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও ভারত-চীন এগিয়ে। পর্যটননির্ভর দ্বীপ দেশটির ঋণ তার মোট জিডিপির প্রায় ১১৩ শতাংশ। এর অর্ধেকের বেশি চীন ও ভারতের কাছ থেকে নেওয়া। এর পরিমাণ প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়াও দেশটির ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের একটি ইসলামিক বন্ড রয়েছে। যার সময়সীমা ২০২৬ সাল পর্যন্ত। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানায়, মালদ্বীপ উচ্চ ঋণসংকটের ঝুঁকিতে রয়েছে। সংস্থাটি স্বাস্থ্যসেবা এবং ভর্তুকি কর্মসূচির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোর সংস্কারসহ ‘জরুরি নীতি সমন্বয়’ করার আহ্বান জানিয়েছে। 

‌এই বিপুল প‌রিমাণ ঋণ থাকার পরেও মুইজ্জুর চীন সফরকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপের সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, চীন মালদ্বীপকে অবকাঠামোগত উন্নয়নে অনুদান সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। এই সহায়তা বা ঋণের মাধ্যমে মালদ্বীপের পূর্ব-পশ্চিম বাণিজ্য রুটগুলোতে চীন প্রবেশাধিকার পেতে পারে।

ইতোমধ্যে দুই দেশের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের কাজ চলছে। মুইজ্জুর ভাষায়, দ্বিপা‌ক্ষিক সম্পর্ক‌ের মাধ্য‌মে তি‌নি ‘বিস্তৃত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বে’ উন্নীত করেছেন এবং মুইজ্জু চীনের বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগে যোগদান করেছেন। যা চীনকে মালদ্বীপে তার উপস্থিতি বাড়াতে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় নজরদারি সম্প্রসারণে সহায়তা কর‌বে।   তবে, চীনের থেকে ঋণ নেওয়ার পরও দেশটি ২০২২ সালে আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে ঋণের ফাঁদে আটকে ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার কথা আমরা সবাই জা‌নি। মালদ্বীপও শ্রীলঙ্কার মত ঋণের ফাঁদে আটকে যায় কিনা সেটিও সময় বলে দেবে। কারণ, ভারতের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে গিয়ে বড় ধরনের সংকট তৈ‌রি হলেও হতে পারে।    লেখক: শিক্ষার্থী