ক্যাম্পাস

জাবিতে ভবন নির্মাণ: বৃক্ষনিধনের পর এবার লেক ভরাটে নজর

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বৃক্ষনিধন এবং লেক ও জলাশয় ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ প্রকল্প ব্যাপকভাবে পরিবেশগত উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে নির্মাণাধীন কলা ও মানবিকী অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন এবং চারুকলা বিভাগের অনুষদ ভবন নির্মাণ প্রকল্পগুলো তাদের পরিবেশগত প্রভাবের কারণে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। ভবন দুটি নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে কাটা পড়েছে দুই শতাধিক গাছ। এখন নির্মাণ কাজ চলমান রাখতে ‘মেইন বার্ডস’ খ্যাত পরিযায়ী পাখির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জলাশয় ভরাটের দিকে নজর দিয়েছেন নির্মাণ প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাবের কথা উল্লেখ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে বারবার তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে এসব উদ্বেগে কর্ণপাত না করে প্রশাসন পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চারুকলা অনুষদের ভবন নির্মাণের জায়গার চারপাশে টিনের বেড়া দেওয়া হয়েছে। কেটে ফেলা হয়েছে ভিতরের সব গাছ। জায়গার পশ্চিমে আল-বেরুণী হল সংলগ্ন মাঠের কোণে থাকা একটি ছোট জলাশয় মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এছাড়া কলা ও মানবিকী অনুষদের সম্প্রসারিত ভবনের জায়গায় গাছ কাটা শেষে লেকের একটি অংশ ভরাট করতে শুরু করেছে প্রকল্প অফিস। তবে গত ১২ জুন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি দল সেখানে গিয়ে কলা ও মানবিকী অনুষদের ভবন নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দেয়।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ। জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, কেউ আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি আইন অমান্যকারীর নিজ খরচে সেটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার বিধানও আছে। তবে এতোসব আইনকানুন থাকা সত্ত্বেও তার তোয়াক্কা করছেন না সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকগণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

সংশ্লিষ্ট প্রকল্প অফিস সূত্রে জানা যায়, কলা ও মানবিক অনুষদের সম্প্রসারিত ভবনের জন্য ৪ কোটি ১৬ লাখ ৯৭ হাজার ৩০৮ টাকা ব্যয়ে ১৩ হাজার স্কয়ার মিটারবিশিষ্ট ছয়তলা ভবন নির্মাণকাজ শুরু করেছে প্রশাসন। জায়গাটির উত্তর-পশ্চিম পাশে লেক, পূর্ব পাশে মূল সড়ক এবং দক্ষিণ পাশে নতুন প্রশাসনিক ভবন রয়েছে। গত ২ জুন ভবনটি নির্মাণ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের 'মেইন বার্ডস' খ্যাত লেকের পাশে প্রায় ২০০ গাছ কাটার পর এবার লেকের একাংশ ভরাট করা শুরু করেছে প্রশাসন। এছাড়া ৯৭ কোটি ৬৯ লাখ ১৭ হাজার টাকা ব্যয়ে ১২০ কাঠা জমির ওপর চারুকলা অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন করা হচ্ছে। এই ভবনেরও একপাশে লেক এবং অন্যপাশে একটি হল ও খেলার মাঠ রয়েছে। এটি তৈরির সময়ও লেকের অন্যপাশ ভরাটের আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে জলাশয় ভরাট, বৃক্ষ নিধন এবং অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ প্রকল্পে মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় পরিবেশবাদী সংগঠন ও সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জোরালো আন্দোলন ও প্রতিবাদ গড়ে তুললেও তা উপেক্ষা করে প্রশাসন ভবন নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এর আগে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের শেষের দিকে উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এজন্য একটি টেকনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট কমিটি (টিএমসি) করা হয়েছিল। তবে সেটি বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই পুনরায় নতুন ভবনের কাজ শুরুর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্বিমুখী নীতির পরিচয় দিয়েছে বলে বলছেন আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ইমন বলেন, আমরা আন্দোলনরতরা কখনোই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন-বিরোধী নই। বরং আমরা চাই সুগঠিত ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন হোক। আল-বেরুনী হলের এক্সটেনশনে প্রশাসন চারুকলা ভবন নির্মাণের যে অনুমতি দিয়েছেন তা বরাবরই উন্নয়নের রূপধারী জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের নকশা। আর তার প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার ‘বেলা’সহ  বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন ও পরিবেশকর্মীরা সংহতি জানিয়ে ‘জাহাঙ্গীরনগর বাঁচাও আন্দোলন’ ব্যানারে মানববন্ধন কর্মসূচি আয়োজন করে। এ বরাদ্দকৃত জায়গায় অতিথি পাখিদের বিচরণ স্থান হিসেবে একটি জলাশয় রয়েছে, যা ভবন নির্মাণার্থে বিপর্যয়মূখী। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী, জলাশয়ের পাড়ে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলে পাখির ফ্লাইং জোন ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তা সত্ত্বেও, প্রশাসন মাস্টারপ্ল্যানের প্রতি অনাগ্রহ দেখিয়ে শত শত গাছ কেটে ফেলেছে এবং জলাশয় ভরাট করছে।

কলা ও মানবিকী অনুষদের সম্প্রসারিত ভবনের স্থানে লেক ভরাটের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অফিসের পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, এখানে ভরাটকৃত জায়গায় লেকটা কোথায়? এখানে ঢালু এবং নীচু জায়গায় এজন্য এটি ভরাট করা হয়েছে। জলাশয়ে পানি থাকবে। কিন্তু এখানে তো কিছু নাই। যদি আপত্তি থাকে বা অভিযোগ থাকে, তাহলে এটাকে বাদ দিয়ে দেখি কীভাবে রিঅ্যারেঞ্জ করা যায়। যতটুকু ভরাট করা হয়েছে আমরা ঠিকাদারকে সরিয়ে নিতে বলেছি। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আমাদের অজান্তেই যদি জলাশয় ভরাট করে ফেলে, তাহলে মাটি সরিয়ে নিতে বলছি।

জলাশয় ভরাটের বিষয়ে জানতে চারুকলা অনুষদ ভবনের প্রকল্প পরিচালক সহযোগী অধ্যাপক এমএম ময়েজউদ্দিনের সঙ্গে টানা তিনদিন যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি গণমাধ্যমের মুখোমুখি হননি। প্রথম দিন ফোন রিসিভ করেননি। দ্বিতীয় দিন প্রশ্ন করার পর মিটিংয়ের কথা বলে কেটে দেন। এছাড়া তৃতীয় দিন প্রথমবার মোবাইল কলে রিং হলেও পরেরবার মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে দেন।