ক্যাম্পাস

১ জনের প্রক্সিতে রাবিতে ভর্তি হয়েছেন ৪ জন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিয়ে চার শিক্ষার্থীর ভর্তি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ৩ থেকে ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথক পৃথক বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত আছেন। তবে তাদের হয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন একই প্রক্সিদাতা। এক অনুসন্ধানে এ সব তথ্য উঠে এসেছে।

জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া ওই চার শিক্ষার্থীর মধ্যে একজনের বিভাগ সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়নি। বাকিরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান সনি, আইন বিভাগের ফাহিম আল মামুন বর্ণ, ফিজিক্যাল অ্যাডুকেশন অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী মো. শোভন।

এদের মধ্যে বর্ণ রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং শোভন রাবি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার ভাতিজা।

এদিকে, ওই প্রক্সিদাতার ছবি সুপার এডিট করায় পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের প্রবেশ পত্রের ছবির সঙ্গে রাবির ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী বায়েজিদ খানের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। এই বয়েজিদসহ তিনজন ২০২২ সালের ২৬ জুলাই রাবির ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক প্রথম বর্ষের ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে গিয়ে আটক হন। পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়োজিত ভ্রাম্যমান আদালতের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কৌশিক আহমেদ তাদের এক বছর করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন।

২০২২ সালের ২৬ জুলাই প্রক্সিকাণ্ডে আটক ঢাবি শিক্ষার্থী এখলাসুর রহমান ও রাবি শিক্ষার্থী বায়েজিদ খান 

প্রবেশপত্রে থাকা চারটি ছবি ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ফোকলোর বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে দেখানো হলে তিনি নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ‘ছবিগুলোর মধ্যে একটি ছবি আমাদের বন্ধু বায়েজিদের। বাকি তিনটি একটু অন্যরকম লাগছে।’

এ ব্যাপারে জানতে বায়েজিদ খানকে কল দেওয়া হলে তার ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, প্রক্সির মাধ্যমে রাবির বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষে অন্তত ২০-২৫ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতেন ফোকলোর বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময়। এ জন্য তিনি নিতেন শিক্ষার্থী প্রতি ৩ থেকে ৮ লাখ টাকা। প্রক্সির গডফাদার হিসেবে খ্যাত এ তন্ময়কে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল রাবি প্রশাসন। পরে প্রক্সির সঙ্গে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে গত বছর ৪ অক্টোবর রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করেন। ২০২২ সালের ২৬ জুলাই ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে গিয়ে আটক হওয়া শিক্ষার্থী বায়েজিদ ও তন্ময় একই বিভাগ ও শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং তারা পরস্পর খুবই ঘনিষ্ঠ।

বর্তমানে তন্ময় জামিনে আছেন বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর রাবির ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার তৃতীয় শিফটে ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া অ্যাকাডেমিক ভবনের ৩১১ নম্বর রুমে মেহেদী হাসান সনির হয়ে প্রক্সি দিয়েছিলেন প্রক্সিদাতা। অ্যাডমিট কার্ডে নিখুঁত কারসাজির কৌশলে পরীক্ষার হলে থাকা দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের চোখ এড়াতে সক্ষম হন ওই প্রক্সিদাতা। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ৭২ দশমিক ৬৫ নম্বর পেয়ে ১৬তম মেধা স্থান অর্জন করেন সনি। তার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ২১১০৩৩৩১৭০ এবং পরীক্ষার রোল নাম্বার ৯৬১১৫। নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার কমলাবাড়ি গ্রামে তার বাসা। বাবার নাম মো. আব্দুল গফুর মণ্ডল ও মাতা মোসা. লায়লি বিবি।

বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের একজন শিক্ষার্থী। ভর্তি পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ডের ছবির সঙ্গে সনির নিজের চেহারার কোনো মিল পাওয়া যায়নি। পরীক্ষার হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা যাতে প্রক্সির বিষয়টা বুঝতে না পারেন, সে জন্য সনির ছবির পরিবর্তে অ্যাডমিট কার্ডে সংযুক্ত করা হয় প্রক্সিদাতার ছবি। তাতে সফলও হন তারা।

এ বিষয়ে মেহেদী হাসান সনি বলেন, আমি এ সবের মধ্যে নেই। পড়াশোনা ও ক্যাম্পাস ছেড়ে একটি হোটেলে কাজ করছি। দুবার ড্রপ আউট হয়ে আমি ক্যাম্পাস ছেড়েছি। তবে আমি ও ধরনের কিছু করিনি। সব তথ্য আমার কাছে আছে। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। আগেও এসব নিয়ে কথা উঠেছিল।

তবে তার কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত চাইলে তিনি দিতে পারেননি। এ প্রতিবেদকের কাছে থাকা কাগজপত্র তাকে দিলে তিনি পরে আর বিষয়টি নিয়ে কথা বলেননি।

অন্যদিকে, প্রক্সিদাতার সহযোগিতায় ফাহিম আল মামুন বর্ণ নামের এক শিক্ষার্থী ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৮২.৬০ স্কোর করে ৪৬তম মেধা স্থান অর্জন করে ভর্তি হন আইন বিভাগে। তার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ২১১০২১৬১২৬ এবং রোল নাম্বার ৫৪১৩৭। তার বাসা রাজশাহী নগরীর রাজপাড়া উপজেলার দাশপুকুর গ্রামে। বাবার নাম মো. মামুনার রশিদ ও মায়ের নাম ফজিলাতুন নেছা। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। তিনি রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে তার মোবাইলে একাধিকার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

একই পন্থা অবলম্বন করে ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৭৯ দশমিক ৭০ নাম্বার পেয়ে ২২তম মেধা স্থান অর্জন করেন মো. শোভন। তার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ২১১০৯২৯১১২ এবং রোল নাম্বার ৭১১০৬। বর্তমানে তিনি ফিজিক্যাল অ্যাডুকেশন অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি রাজশাহীর মতিহার থানার বুধপাড়া গ্রামের মো. গোলাম সারওয়ার ও মোসা. সেলিনা বেগমের পুত্র। তিনি রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার ভাতিজা।

এ বিষয়ে জানতে শোভনের মোবাইলে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও নম্বর বন্ধ পাওয়ায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যে প্রক্সিদাতা সনির হয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তিনিই বর্ণ, শোভন ও মো. মিরাজুল ইসলাম শাওন (রোল- ৭০৩৫৯) নামের এক শিক্ষার্থীর হয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তবে মূল পরীক্ষার্থীর শরীরের গঠনের সঙ্গে মিল রেখে অ্যাডমিট কার্ডে ছবি এডিট করা হয়েছে। কারও অ্যাডমিট কার্ডে এডিট করে ছবি মোটা করে দেওয়া হয়েছে, আবার কারও ক্ষেত্রে চিকন করে দেওয়া হয়েছে।

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও বর্তমানে ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. এসএম এক্রাম উল্যাহ বলেন, এ ঘটনাটা আমার সময়ের না। তবে ভর্তি পরীক্ষায় কেউ জালিয়াতি করলে কোনো প্রকার ছাড় পাবে না। বিষয়টা তদন্ত হওয়া উচিত। এটা যদি সঠিক হয়, তাহলে মাননীয় উপাচার্য শক্ত হাতে সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার সভাপতি অধ্যাপক মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, যদি প্রমাণিত হয় যে ওই শিক্ষার্থীরা অসদুপায় অবলম্বন করেছেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ শাস্তি হবে। যে কোনো কাজ করতে গেলে ত্রুটি বিচ্যুতি হতে পারে। সে সময় হয়তো তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে এখন যেহেতু অভিযোগটা উঠেছে, তাহলে এটার তদন্ত করে প্রমাণিত হলে শাস্তির আওতায় আনা উচিত।

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব বলেন, অভিযোগটা যদি ডকুমেন্টেড ও প্রমাণিত হয়, তাহলে তাহলে আমাদের প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ নেবেন। কোনো প্রকার নমনীয়তা বা দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভিতরে যাব না।