ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য ও প্রশাসনিক পদে নিয়োজিত বেশিরভাগ শিক্ষকই পদত্যাগ করেছেন। নতুন করে নতুন রূপে উদ্যমী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের কাজে নেমেছেন। এমনকি এ কর্মযজ্ঞে বিভিন্ন শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর মতো ঘটনার সাক্ষীও হয়েছে দেশবাসী।
একজন পদত্যাগ করেছেন, অন্যজন সেই পদে নিযুক্ত হচ্ছেন। এভাবে মাথা পরিবর্তন করে কতটা সংস্কার সম্ভব, সে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। তাই হাঁটতে হবে দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই সংস্কারের পথে, যার ফলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘সেকেন্ড হোম’ বলে মনে করে আর অনুতপ্ত বোধ করবে না। সেশনজটের গ্যাঁড়াকলে ভবিষ্যৎ দীর্ঘদিন ঝুলে থাকবে না। ধীরে ধীরে সমাধান হতে শুরু করবে ক্লাস-ল্যাব-শিক্ষক সংকটসহ সব সমস্যার।
সংকট নিরসনে প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারে নামতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়ায় হাত দিতে হবে। জানতে হবে, এতো হাজার হাজার শিক্ষার্থী, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী, দৈনিক নানা কার্যক্রম-কর্মসূচি কীভাবে পরিচালিত হয়? কারা পরিচালনা করে? পরিচালনায় কোন ত্রুটির কারণে শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? প্রশ্ন করতে জানলেই মিলবে উত্তর। তারপর সেই উত্তরকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করতে পারলেই হবে সংস্কার।
মূলত, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য উপাদান শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। মুখ্য উপাদানগুলোকে সেবা দেওয়া কিংবা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সাপোর্ট সার্ভিসমূলক শাখা বা পদ থাকে। পদগুলোর মধ্যে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ এ তিনটি পদ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত।
এছাড়া বিভিন্ন দপ্তর পরিচালনার জন্য রেজিস্ট্রার, গ্রন্থাগারিক, হিসাব শাখার পরিচালক, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক, তথ্য ও প্রযুক্তি শাখার পরিচালক, অডিট শাখার প্রধান, পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও কর্ম শাখার প্রধান, প্রকৌশল শাখার প্রধান ছাড়াও বেশকিছু পদ আছে, যাদের নিয়োগ দেন উপাচার্য।
নিয়ম অনুযায়ী, এই পদগুলোতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কেউ স্থায়ীভাবে প্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন। অবসরে যাওয়ার পর কিংবা দুর্নীতির প্রমাণ মিললে উক্ত পদে সেই শাখার অন্য কেউ দায়িত্ব পালন করবেন। যেন কোনো উপাচার্যের আমলের হিসাব কিংবা নথিপত্র সেই উপাচার্য পরিবর্তনের পরপরই পরিবর্তন হয়ে না যায়। তাছাড়া পরবর্তীতে তদন্ত করলে স্বচ্ছ হিসাব পাওয়া যাবে এবং না পেলেও সেই শাখার পরিচালক তার দায়ভার নিতে বাধ্য হবেন। এমনকি তারা উপাচার্যের আদেশ অনুযায়ীও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বহির্ভূত কর্ম সম্পাদনে অসম্মতি জানাবেন।
কিন্তু বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব পদগুলোতে স্থায়ীভাবে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয় না। অজুহাত হিসেবে, ‘যোগ্য ব্যক্তি পাওয়া যায়নি’ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। ফলে উপাচার্যরা নিয়োগ পেয়ে আপন মর্জিতে পছন্দের শিক্ষকদের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সে সব পদগুলোতে বসান, যাতে করে ইচ্ছামতো ছড়ি ঘোরাতে পারেন।
এছাড়াও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, পরিচালনা ও সেবা সংশ্লিষ্ট কিছু পদ বা শাখা থাকে। যেমন- ছাত্র পরামর্শ বিভাগের পরিচালক ও তার সহকারীসহ আরও কয়েকজন মিলে ছাত্র পরামর্শ বিভাগ। ঠিক একইভাবে প্রক্টর, কয়েকজন সহকারী প্রক্টর, হল সুপার, সহকারী হল সুপার, শারীরিক শিক্ষা বিভাগের প্রধান, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইত্যাদি পদগুলোও থাকে। যেহেতু ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই বিভিন্ন বিভাগের যোগ্য অধ্যাপকদের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এ পদগুলোতে তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়।
পাঠদানের অতিরিক্ত কর্ম সম্পাদনের কারণে একজন রেজিস্ট্রার, কোষাধ্যক্ষ, প্রক্টর, ছাত্র পরামর্শ বিভাগের পরিচালক, হল সুপার (প্রাধাক্ষ), গ্রন্থাগারিকসহ অন্যান্য প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত শিক্ষকরা বেতনের অতিরিক্ত প্রতি মাসে সাড়ে ৪ হাজার টাকা সম্মানী পান। পদগুলোর সহকারী (সহকারী প্রক্টর, সহকারী হল প্রাধাক্ষ, ছাত্র পরামর্শ বিভাগের সহকারী পরিচালক ইত্যাদি) ব্যক্তিরা বেতনের অতিরিক্ত ২ হাজার ৭০০ টাকা পেয়ে থাকেন।
অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে বিভাগগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কর্ম সমন্বয় করার জন্য একজন সভাপতি থাকেন এবং বেশ কয়েকটি বিভাগ মিলে হয় একটি অনুষদ; যার প্রধান ডিন। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বিভাগের একজন অধ্যাপককে তিন বছরের জন্য ওই বিভাগের সভাপতি ও একইভাবে পালাক্রমে অনুষদের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের একজনকে দুই বছরের জন্য ডিন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সভাপতিকে অতিরিক্ত দায়িত্ব বাবদ সাড়ে ৪ হাজার ও ডিনকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা সম্মানী দেওয়া হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা পাঠদান ও গবেষণা ব্যতীত যে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন, তারা সেটা কখন পালন করেন?
উত্তর হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও গবেষণার জন্য যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তিনি বেতনভুক্ত, সে সময়েই করেন। কখনো কখনো সে সময়ের অতিরিক্ত সময় দায়িত্ব পালনে চলে যায়। প্রক্টর, ছাত্র পরামর্শক, হল সুপারদের তো কাজের নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। মাঝরাত কিংবা ভোর, যখনই অসংগত কিছু হবে, তাদের সেটা সমাধান করতেই হবে। আবার মাঝে মাঝে আলোচনা সভা ও বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিতে হয়। কেউ নিশ্চয়ই সাড়ে ৪ হাজার কিংবা ২ হাজার ৭০০ টাকার আশায় এত গুরু দায়িত্ব কাঁধে নেন না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক কোনো গবেষণা প্রজেক্ট চালালে বছরে ৫০-৬০ হাজার টাকা পাওয়া যায়, যা ওই সব পদে দিনরাত খাটুনির পর পাওয়া অর্থের তুলনায় বেশি।
এ ক্ষেত্রে মূল আকর্ষণ হলো ক্ষমতা। উক্ত পদে বসে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন কাজের অগ্রগতিতে হস্তক্ষেপ করা যায়, পছন্দের মানুষকে সুবিধা দেওয়া কিংবা মতের অমিল কাউকে দাবিয়ে রাখার মতো কাজ করা সম্ভব হয়, থাকা যায় উপাচার্যের কাছাকাছি, করা যায় বিভিন্ন শাখা কর্তৃক আয়োজিত কর্মসূচিতে কেনাকাটার অর্থের হিসাবে গড়মিল দেওয়ার মাধ্যমে নিজের পকেট ভারি, নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে সুবিধা দেওয়া যায়।
এছাড়াও ভর্তি পরীক্ষা, বিভিন্ন তদন্ত কমিটি ও নানা কাজের জন্য কমিটি গঠিত হলে সেখানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ লুফে নেওয়া যায়। ফলে টাকা কত পাওয়া যাবে, সেটা হিসাবে ধরা হয় না। ক্ষমতাটাই আসল হয়ে ওঠে। ক্ষমতার গদিতে বসে ব্যস্ততার কারণে ওই শিক্ষকের রুটিন অনুযায়ী যে ক্লাস থাকে, সেটাতে অংশ নিতে বিলম্ব হয় কিংবা ব্যস্ততার কারণে মাঝে মাঝে অংশগ্রহণ করাই হয়ে ওঠে না। ফলে সিলেবাস সঠিক সময়ে শেষ হয় না, কিংবা গড়মিল দিয়ে শেষ করা হয়। সৃষ্টি হয় সেশনজট, তৈরি হয় না দক্ষ গ্র্যাজুয়েট এবং বৃদ্ধি পায় বেকারের সংখ্যা।
এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের প্রথম ধাপ হিসেবে নতুন উপাচার্য যোগদান করার সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদগুলোতে শিক্ষকদের অতিরিক্ত দায়িত্ব না দিয়ে স্থায়ী কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য চাপ দিতে হবে। যাতে করে চার বছর মেয়াদী উপাচার্য পরিবর্তনের সঙ্গে সাঙ্গে তার আমলনামা হারিয়ে না যায়। পরবর্তী উপাচার্য পূর্ববর্তী উপাচার্যের আমলের কোনো অসংগতি আলোকপাত করলে, তার সুষ্ঠু তদন্ত করতে পারে।
এছাড়া শিক্ষকদের জন্য সেই পদগুলো বন্ধ হলে, তাদের মধ্যকার দলাদলি, লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি ও ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে ক্লাস নেওয়ার প্রতি অনীহা কিছুটা হলেও কমে যাবে। যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করবে, সেশনজট কমিয়ে আনবে এবং শিক্ষকরাও গবেষণার প্রতি মনোনিবেশ করতে পারবেন। ফলে তাদের অ্যাকাডেমিক প্রোফাইল আরও সমৃদ্ধ হবে।
এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মনে রাখা উচিত, অ্যাকাডেমিক প্রোফাইল নিয়ে না ভেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা কিংবা উপাচার্যের তোষামোদ করা কোনো শিক্ষকের জন্য মান-সম্মান বয়ে আনে না। বরং শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা কমায়। তাহলে সংস্কার শুরু হোক সবচেয়ে শিক্ষিতদের দিয়েই।
অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ গঠন, রিজেন্ট বোর্ডের সভায় ছাত্র প্রতিনিধি রাখা নিশ্চিত করা, আবাসিক হলগুলোতে আসন সঠিকভাবে বণ্টন করা, ক্রেডিট ফি কমানো, ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার মতো পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সংস্কার কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
(বিঃদ্রঃ যে সব পদের নাম ও টাকার পরিমাণ দেখানো হয়েছে, সেগুলো হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) বিভিন্ন শাখা ও বেতন কাঠামো অনুসারে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে পদগুলোর নাম ভিন্ন ও টাকার পরিমাণ কম বা বেশি হতে পারে।)
লেখক: শিক্ষার্থী, কৃষি প্রকৌশল বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর