চীন একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ইতিহাসে পরিপূর্ণ দেশ। সারা বছর চীনে বিভিন্ন উৎসব পালিত হয়, যা তাদের ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। মিড-অটাম ফেস্টিভ্যাল বা মধ্য-শরৎ উৎসব- চীনা সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী অংশ। এটা মুন ফেস্টিভ্যাল বা চাঁদ উৎসব নামেও পরিচিত।
এ উৎসবটি মূলত ফসল তোলার উৎসব। চীনা ভাষায় একে বলা হয় চোং ছিউ চিয়ে (中秋节)। অন্যতম প্রধান এ সামাজিক উৎসবকে চীনা সংস্কৃতিতে বসন্ত উৎসবের পরেই স্থান দেওয়া হয়।
চীনা বর্ষপঞ্জিকা অনুযায়ী অষ্টম চন্দ্র মাসের ১৫তম দিনে পূর্ণিমায় এই উৎসব পালন করা হয়। সাধারণত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এবং অক্টোবরের শুরুর মধ্যে কোথাও এই দিনটি পড়ে। উৎসবটি সেই সময় পালিত হয় যখন চাঁদ তার পূর্ণতম এবং উজ্জ্বলতম অবস্থায় থাকে। এ বছর মিড-অটাম ফেস্টিভ্যাল আজ মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) উদযাপিত হবে।
মিড-অটাম ফেস্টিভ্যাল বা মধ্য-শরৎ উৎসবের উৎপত্তি হয়েছিল প্রায় ৩ হাজার বছর আগে, যখন চীনে ঝাউ রাজবংশের শাসন ছিল। এ সময়ে সম্রাট প্রচুর ফসলের জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাঁদের পূজা করেছিলেন। ধীরে ধীরে এ ঐতিহ্যটি সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি জনপ্রিয় আচার-অনুষ্ঠানে বিকশিত হয়, যারা চাঁদকে আশা ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবেও দেখেছিল। প্রাচীন চীনে চাঁদকে উর্বরতার প্রতীক বলেও মনে করা হতো।
প্রাচীন জুয়াং জাতির বিশ্বাস ছিল, চাঁদ ও সূর্য হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী এবং তারকারাজি হচ্ছে তাদের সন্তান। এবং তারা এই বিশ্বাস করত চাঁদ যখন গর্ভবতী হয় তখন গোলাকার আকৃতি ধারণ করে এবং সন্তান প্রসবের পর পরিণত হয়ে এক ফালি চাঁদে। চাঁদের সঙ্গে নারীর রজঃস্বলা এবং সূর্যের সঙ্গে পুরুষত্বের সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হতো। চীনের অনেক অঞ্চলে নারীরা চাঁদকে পূজা করতো, আর পুরুষরা করতো সূর্যের। এ উৎসবটি অন্যতম অংশ হচ্ছে চাঁদের দেবীর উপাসনা করা। এছাড়া বিভিন্ন তথ্য মতে, এই উৎসবটি চাঁদের দেবী চাং-ই এর উপাসনার জন্য করা হয়।
চাঁদের উপাসনার বিষয়ে একটা পৌরাণিক কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে যে, প্রাচীনকালে হৌ-ই নামের একজন তীরন্দাজ ছিলেন। একদিন তারা দেখতে পেলেন আকাশে একসাথে দশটি সূর্য উদিত হয়েছে। দশটি সূর্যের তাপে তখনকার জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। যখন সবাই সূর্যের তাপ থেকে পরিত্রাণ চাচ্ছিল, তখনই দুর্দান্ত তীরন্দাজ হৌ-ই তার তীরের আঘাতে নয়টি সূর্যকে ভূপাতিত করেছেন, বাকি একটি সূর্য রেখেছেন আলো দেওয়ার জন্য। হৌ-ই’র এ বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে স্বর্গের দেবতারা তাকে এক পাত্র অমৃত উপহার দেন। অমৃত পান করলে তিনি সারা জীবন অমর হয়ে থাকবেন এবং একজন দেবতায় রূপান্তরিত হয়ে অমৃতলোকে বসবাস করবেন। কিন্তু বীর হো-ই তার স্ত্রী চাং-ই’কে অনেক ভালোবাসতেন। কিন্তু এই অমৃত শুধু একজনের জন্যেই ছিল। তাই তিনি অমর হয়ে অমর্ত্যলোকে চলে যাওয়ার থেকে তার স্ত্রীর সাথে বসবাস করাটাকেই বেশি প্রাধান্য দিলেন এবং সেই অমৃত পাত্রটি ঘরে এনে রেখে দিলেন। ফাং মাং নামে হৌ-ই’র এক লোভী শিষ্য অমৃত পাত্র ঘরে রাখার ব্যাপারটি জেনে গেল।
একদিন হৌ-ই শিকারের জন্য বাইরে গেলে লোভী ফাং মাং গুরু হৌ-ই’র ঘরের দরজা ভেঙ্গে প্রবেশ করে এবং স্ত্রী চাং-ই কে অমৃতের পাত্র দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। উপায়ান্তর না দেখে চাং-ই শিষ্য ফাং মাং এর মতো খারাপ লোক যেন দেবতা হতে না পারে, তাই তিনি নিজেই অমৃত সুধা পান করেন। তখন তিনি দেবী হয়ে যান। তিনিও তার স্বামীকে বড্ড ভালোবাসতেন, স্বামীর কাছাকাছি থাকার উদ্দেশ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি চাঁদে বসবাস শুরু করেন। হৌ-ই শিকার থেকে ফিরে সব শুনে বিরহে কাতর হয়ে চাঁদের উদ্দেশ্যে উপাসনা শুরু করেন এবং তার স্ত্রীর প্রিয় খাবার উঠানে নৈবেদ্য হিসেবে উৎসর্গ করেন। এ ঘটনা চারদিকে রটিয়ে পড়লে হৌ-ই’র দেখাদেখি সবাই চাঁদের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য নিবেদন করা শুরু করেন। সেই থেকে চন্দ্র পূজা হাজার বছর ধরে চলে আসছে।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি পৌরাণিক কল্পকাহিনী কাহিনী প্রচলিত আছে। নয়টি সূর্যকে ভূপাতিত করার পর হৌ-ই’র বীরত্বের কথা চারোদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং সবাই তার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে তাকে রাজা বানায়। কিন্তু কালক্রমে তিনি অত্যাচারী শাসকে পরিণত হন। স্ত্রী চাং-ই মনে করলেন এই অত্যাচারী রাজা যদি অমর হয়ে অনন্তকাল রাজ্যের প্রজাদের অত্যাচার চালিয়ে যান তাহলে তাদের দুর্দশা শেষ থাকবে না। তাই চাং-ই নিজেই অমৃত পান করেন। ওই রাগে ক্ষোভে স্ত্রীকে মারার উদ্দেশ্যে রাজা হৌ-ই তীর ছোড়েন কিন্তু তার আগেই চাং-ই চাঁদে পৌঁছে যান এবং সেখানেই বসবাসের শুরু করেন। ক্ষোভ ও হতাশায় কিছুদিনের মধ্যে হৌ-ই মৃত্যুবরণ করেন। রাজ্যের প্রজারা চাং-ই’র এ মঙ্গলময় কাজে খুশি হয়ে তার উদ্দেশ্যে উপাসনা ও নৈবেদ্য উৎসর্গ করা শুরু করেন। সেই দিনটি ছিল চন্দ্র বর্ষের অষ্টম মাসের ১৫ তারিখ পূর্ণিমার দিন।
এ চাঁদ উৎসবকে কেন্দ্র করে আরও বেশ কয়েকটি পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে। তবে বর্তমান সময়ে এ উৎসবটির ধর্মীয় তেমন গুরুত্ব না থাকলেও পারিবারিক পূর্ণমিলন ও ফসল কাটার উৎসব হিসেবেই বেশি উদযাপিত হয়ে আসছে। এইদিন চীনারা সবাই মিলে চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করেন এবং পরিবারের সবাই মিলে একসাথে রাতের খাবার খান। এ সময় তাদের খাবারে তালিকায় তাজা ফলমূল ও মুন কেক থাকে।
মিড-অটাম ফেস্টিভ্যালের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে, মুন কেক বানানো ও খাওয়া। এটি গোলাকার, যা পারিবারিক পুনর্মিলন ও পূর্ণ চাঁদের প্রতীক। এছাড়াও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে একে অপরকে এবং আত্মীয়-স্বজনদের মুন কেক উপহার দিয়ে থাকেন।
মধ্য শরৎ উৎসব উদযাপনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো লণ্ঠন তৈরি করা এবং লণ্ঠন জ্বালানো। বিভিন্ন আকার ও ধরনের লণ্ঠনগুলো বাড়ির বাইরে এবং জনবহুল জায়গায় ঝুলানো হয়, যা এ উৎসবের পরিবেশ আরও বেশি আবেদনময় করে তোলে। শিশুরা প্রাণী বা কার্টুন চরিত্র আকারের লন্ঠন বহন করে। এখন বড়রাও ঐতিহ্যবাহী লণ্ঠনের নকশার ও সৌন্দর্য্য উপভোগ করে।
বর্তমানে আধুনিক চীনে ঐতিহ্যবাহী এ সব ধর্মীয় উপাসনার বা ফসল কাটার কার্যকলাপ দেখা না গেলেও মুন কেকের প্রচলন খুব ই লক্ষণীয়। চীনের বেশ কয়েকটি খ্যাতনামা খাবার প্রস্তুতকারী দোকান এ মুন কেক তৈরি করে থাকে। সাধারণত সুদৃশ্য নকশা খচিত বাক্সে বিভিন্ন স্বাদের মুন কেক সাজিয়ে রাখা হয়। এই উৎসবে অতিথিরা একে অপরের বাড়িতে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় নিমন্ত্রণকর্তার জন্য নকশা খচিত মুন কেকের বাক্স উপহার নিয়ে যান। এছাড়াও বর্তমানে সুউচ্চ ভবনে এবং জনবহুল জায়গায় সুন্দর মনোরম লণ্ঠন প্রদর্শনী এবং জাঁকজমকপূর্ণ মিড-অটাম ফেস্টিভ্যালগুলো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইনফরমেশন সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, নানজিং ইউনিভার্সিটি, চীন