ক্যাম্পাস

এবার সামনে আসলেন ঢাবি শাখা ছাত্র শিবিরের সাধারণ সম্পাদক

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতির পর এবার সামনে আসলো সাধারণ সম্পাদকের পরিচয়। একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, সাধারণ সম্পাদকের নাম এস এম ফরহাদ।

সূত্র বলছে, তিনি ঢাবির সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৭-১৮ সেশনের এবং কবি জসিম উদ্দীন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী এসএম ফরহাদ। তিনি ২০২২-২৩ সেশনে জসীম উদদীন হল ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতিও ছিলেন। এছাড়া তিনি ঢাবিতে অধ্যয়নরত পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। তারপর ধীরে ধীরে সরকার পতনের আন্দোলন বেগবান হয়। ছয় প্রধান সমন্বয়ককে গুম করা ও ডিবি অফিসে আটকে রাখা হয়। এমতাবস্থায় অন্য সমন্বয়করা ঢাবি শিবিরের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তৈরি করেন ৯ দফা। ফেসবুক পোস্টে এমনটাই জানিয়েছেন সমন্বয়ক আব্দুল কাদের।

আব্দুল কাদেরর ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমেই জানা যায় জুলাই বিপ্লবে শিবির কিভাবে অবদান রেখেছে। ‘ঐতিহাসিক নয় দফা নিয়ে কিছু কথা’- শিরোনামে দেওয়া তার পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

“কোটা সংস্কারকে উদ্দেশ্য করে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল; কিন্তু সরকার পরিস্থিতি ঘোলাটে করলে আন্দোলন ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় নয় দফার অবতারণা হয়।

আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ১৬ তারিখ মঙ্গলবার আবু সাঈদ সহ ৬ জন যখন শহীদ হয়, ঐদিন রাত ১২টায় সামনের সারির সমন্বয়করা মিলে আমরা একটা অনলাইন মিটিং করি। মিটিং-এ প্রথম এজেন্ডা-ই ছিল, আজকে যে ছয়জন শহীদ হইলো, এই ছয়টা লাশের বিনিময়ে শুধু কোটা সংস্কার কি না? তখন সবাই  হই হই করে বলে উঠে, ছয়টা লাশের বিনিময়ে শুধু কোটা সংস্কার হতে পারে না। পরবর্তীতে দীর্ঘক্ষণ আলাপ আলোচনা করা হয়। এই আলোচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিসহ আরো কিছু দাবি দাওয়া উঠে আসে।

বলে রাখা ভালো, আমরা এতোদিন ‘বাংলা ব্লকেড’ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি পেশসহ নানা সফট এবং হার্ড কর্মসূচি নিয়ে মাঠে অবস্থান করেছিলাম। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে একেবারে নির্বিকার-নির্লিপ্ত মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল। আলাপ-আলোচনার দ্বারধারে নাই সরকার, কেবল হাইকোর্টে কাঁধে বন্দুক রেখে চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি যখন বেগতিক হয়ে যায়, ৬ জন শহীদ হয়, ঐদিনই সরকার আলোচনার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দেয়, আমাদেরকে বিভিন্ন মাধ্যমে চাপ দিতে থাকে আলোচনায় বসার জন্য। কিন্ত আমরা আলোচনার আহ্বানকে বারাবরের মতোই প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করি। যদিও ভিতর বাহির থেকে আলোচনায় বসার নানারকম চাপ আসছিল।

সরকার সংলাপের আহ্বান ফরমালি জানিয়েছিল। কিন্ত সেটার প্রেক্ষিতে আমরা আমাদের অবস্থান ফরমালি ক্লিয়ার করি নাই। ক্লিয়ার করার সুযোগও পাই নাই। বুধবার গায়েবানা জানাযায় ঢাবি ক্যাম্পাসে পুলিশ আমাদের উপর গুলি চালায়। আমিসহ কয়েকজন আহত হই। হান্নান মাসউদ গুলিবিদ্ধ হয়। তখন থেকেই আমরা আন্দোলন পরিচালনা করে যাবার স্বার্থে কৌশলী অবস্থান নিয়ে গ্রেফতার এড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। যদিও সরকারের সংলাপকে প্রত্যাখ্যান করে মঙ্গলবার রাতে আমরা কিছু দাবি দাওয়া ঠিক করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে সবাই মিলে আলাপ-আলোচনা করে যে সেই দাবিগুলো ফাইনাল করবো সে সময় পাইনি। তবে আমরা বৃহস্পতিবার মাঠের কর্মসূচি (কমপ্লিট শাটডাউন) দিয়ে নিজেদের অবস্থান ক্লিয়ার করেছিলাম।

বৃহস্পতিবার আমি আর আসিফ ভাই এক বাসা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যে চলে যাই। ঐদিন ১৮ তারিখ রাতেই ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার। আমরাও কর্মসূচি চলমান রাখতে, গ্রেফতার এড়াতে বার বার জায়গা পরিবর্তন করে বেড়াচ্ছি। কারো সাথে তেমন কোনো যোগাযোগ করতে পারতেছি না। আন্দোলনের শুরুতেই নাহিদ ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে এক লোকের সাথে মিট করায় এবং পরবর্তীতে আন্দোলনের পারপাসে একাধিকবার ঐ লোকের সাথে যোগাযোগ হয়; পরবর্তীতে জানতে পারি তিনি ঢাবি শিবিরের ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। কিন্ত তখনও শিবিরের সভাপতি এবং সেক্রেটারির সাথে ঐভাবে যোগাযোগ হয় নাই। 

শুক্রবার যাত্রাবাড়ি এলাকায় যখন আন্দোলন করছিলাম তখন শিবিরের ঢাবি সেক্রেটারি ফরহাদ ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বলল- ‘আন্দোলনরত কয়েকজন সমন্বয়ক সরকারের মন্ত্রীদের সাথে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে। এতো এতো শহীদের রক্তের সাথে বেইমানী করতেছে তারা। আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে। কিছু দাবি-দাওয়া দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, মানুষের সাথে বেইমানি করা যাবে না।’ আমি সম্মতি জানাই। আমাদের তো আগেই অবস্থান ছিল আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার। তাছাড়া মঙ্গলবার রাতের মিটিংয়ে ঠিক করা কিছু দাবি দাওয়া আমার মাথায় আছে।

আন্দোলন চালিয়ে নেয়ার মতো মাঠে কোনো সিনিয়র নাই। আসিফ-নাহিদ ভাইকে গুম করে রেখেছে। আমি সাত-পাঁচ না ভেবে রিস্ক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ঐদিন জুমার নামাজের পর পরই যাত্রাবাড়ীতে কয়কজন শহীদ হয়, সবগুলা আমার চোখের সামনেই ঘটতেছে। মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলতেছে, এটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারতেছিলাম না। তাছাড়া দীর্ঘদিন জেল-জুলুম, হামলা-মামলার শিকার হয়ে হাসিনার এমন অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছি; মাথা নত করি নাই। আমার পরিণতি কি হবে, সেটা ঘুর্ণাক্ষরেও কল্পনা করি নাই। চোখের সামনে মানুষ মেরে ফেলতেছে, মানুষের কথা চিন্তা করে নিজের জীবনের কথা ভাবার সময় পাই নাই। গত ৪/৫ বছর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই আমাদেরকে দৃঢ়তা ধরে রাখার শিক্ষাই দিয়েছে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে হাল ধরার সিদ্ধান্ত নিই।

যাইহোক, কিছুক্ষণ বাদে শিবিরের সেক্রেটারি আমাকে আবারও ফোন দিল। বলতেছে, ‘কিছু দাবি দাওয়া খসড়া আকারে করছি, তোমার সাথে আলোচনা করি।’ আমাদেরও যেহেতু আগেই আলোচনা হয়েছিল অনেকগুলো দাবির ব্যাপারে, সেগুলো তখন উনার সাথে আলোচনা করে সমন্বিত ভাবে তৈরি হয় ৯ দফা। 

তিনি একে একে কিছু দাবি বললেন, যেগুলা খুব কমন দাবিদাওয়া। যেমন- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ, ছাত্র হত্যার সাথে জড়িত পুলিশ প্রশাসনকে বরখাস্ত, সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনা, ভিসির পদত্যাগ। যেগুলা ৬ জন শহীদ হওয়ার পরে মঙ্গলবার রাতের বৈঠকের আলোচনাতেই আমরা ভেবেছিলাম। এছাড়া মানুষজনও সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কিছু দাবিদাওয়া জানিয়ে আসছিল। শেষের দিকে গিয়ে শিবিরের সেক্রেটারি একটা দাবি এড (যুক্ত) করল- ‘ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে’। এটা আমি মানি নাই, দীর্ঘক্ষণ আলাপ আলোচনা হইলো।

পরে আমি বললাম, ঢালাওভাবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলতে পারেন। পরে সেটাই ঠিক হইলো- ‘লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।’ এই হইলো নয় দফা তৈরির পেছনের গল্প। তবে নয় দফা প্রচার-প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল শিবির। যেহেতু নেট নাই, গোলাগুলি-কারফিউ'র মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সশরীরে হাউজে হাউজে পৌঁছে দিয়েছে। বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা তারাই করেছে।

আমাকে নতুন একটা সীম এবং মোবাইল কালেক্ট করার পরামর্শ দিল তারা। আমি স্টুডেন্ট এর বাসা থেকে সীম নিয়ে ঐ নাম্বারটা নয় দফা সংবলিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির সাথে দিয়ে দিলাম। ঐদিন সন্ধ্যায়  বাসা থেকে ৪-৫ কিলো দূরে হেটে গিয়ে পরিচিত সাংবাদিকদেরকে ফোন দিয়ে নয় দফার বিষয়টা জানাইলাম। টুকটাক ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে ক্যাম্পাসের সাংবাদিকদের সাথে আমার পরিচয় ছিল। তো ঐ রাতে তাদের অনেককে একটা একটা করে কয়েক দফা বাটন ফোন দিয়ে ম্যাসেজের মাধ্যমে দাবিগুলা লিখে পাঠাইছি। পুরা নয়টা দাবী একসাথে ম্যাসেজে পাঠানো যায় না। কাউকে আবার মুখে বলে দিছি, সে লিখে নিছে। কেউ আবার রেকর্ড করে নিছে। কনফার্ম হওয়ার জন্য অনেকেই ফোন দিছে, এটা আসলেই আমি দিছি কি-না। বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলাকেও ফোন দিয়ে কনফার্ম করা লাগছে, ‘আমার পক্ষ থেকে এটা যাচ্ছে, আপনাকে একজন পেনড্রাইভের মাধ্যমে পৌঁছে দিবে।’ এইভাবে চলল রাতের ১১টা পর্যন্ত।  

প্রতিদিন রাতের বেলায় বাসা থেকে দূরে চলে যেতাম। ফোন অন করে সাংবাদিকদের সাথে ২-৩ ঘন্টা কথাবার্তা বলে, তাদেরকে কনফার্ম করে, ফোন বন্ধ করে আবার বাসায় ফিরতাম। সিনিয়ররা গুম অবস্থায় ছিল, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা যাচ্ছিলো না বাকিদের সাথেও। এইভাবেই চলতে থাকলো। আমার বাসা ছিল যাত্রাবাড়ী থানার পাশেই। গ্রেপ্তারের আতঙ্ক, তারপরও বাসায় থাকতে হতো। শুরুতেই যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। কোনো রাত মসজিদে কাটাইছি, কোন রাত অর্ধেকটা বাহিরে কিংবা বাসার ছাদে কাটিয়ে শেষ রাতে বাসায় ফিরেছি।

এইতো ঐতিহাসিক নয় দফা, আমাদের নয় দফা, ফ্যাসিস্ট হাসিনা থেকে মুক্তি লাভের সনদ!”