ক্যাম্পাস

শিক্ষক দিবস ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন

আজ ৫ আগস্ট, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এমন সময় এ দিবস পালন হচ্ছে, যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পাশাপাশি শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক পট পরিবর্তন হয়ে গেছে। এ বছর ইউনেস্কো ঘোষিত শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য  নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘Valuing teachers' voices: towards a new social contract for education.’

বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপনের জন্য ইউনেস্কো এবং অ্যাডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (ইআই) প্রতিবছর একটি প্রচারাভিযান চালায়, যাতে শিক্ষকদের দায়িত্ব-কর্তব্য তুলে ধরা হয়। ২০২৪ সালের শিক্ষার প্রতিপাদ্য বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এখানে শিক্ষকদের কণ্ঠের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আজ দেখা যায় সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন মহল থেকে বারবার শিক্ষকদের টুটি চেপে ধরা হচ্ছে। তাহলে শিক্ষা কিভাবে সামাজিকীকরণের দিকে যাবে?

শিক্ষকদের পাহাড় সমান অভিযোগ কাউকেই বলতে পারেন না এবং এর বৈষম্যের চিত্র দিনে দিনে আরও ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। শিক্ষক মানে জাতির আলোকবর্তিকাবাহী, সভ্য মানব গড়ার স্বীকৃত কারিগর, বন্ধু, দার্শনিক, পথ প্রদর্শক, দর্শন তত্ত্বের পণ্ডিত। শিক্ষক হল শিক্ষার্থীর দর্পণ স্বরূপ। তাইতো বলা হয় ‘A great teacher is like a candle it consumes itself to light the way for others.’

একজন সক্রেটিস জন্মেছিল বলেই একজন প্লেটো, এরিস্টটল হয়ে আলেকজান্ডার জন্মেছিল।  সক্রেটিসের অমর বাণী ‘আমি কাউকে কিছু শেখাতে পারিনা আমি কেবল তাদের ভাবাতে পারি।’ বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটোর জীবনের সবচেয়ে বেশি যিনি প্রভাব ফেলেছিলেন, তিনি হলেন মহামতি সক্রেটিস। তার জীবনে সক্রেটিসের প্রভাব অতি সুস্পষ্ট। কারণ সক্রেটিসের সব কথোপকথন প্লেটোই লিখে গেছেন।  প্লেটো তার শিক্ষক সক্রেটিস সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘সক্রেটিস এমন একজন মানুষ, যিনি মহানদের মহান।’

গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘যারা শিশুদের শিক্ষাদানে ব্রতী, তারা অবিভাবকদের থেকেও অধিক সম্মানীয়।’ একইভাবে বিখ্যাত বীর আলেকজান্ডার তার শিক্ষক ডায়োজিনিস সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি যদি আলেকজান্ডার না হতাম, তবে ডায়োজিনিস হতে চাইতাম!’ পৃথিবীর যুগে যুগে যে সব ধর্মীয় মহাপুরুষগণ এসেছেন তারাও শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কাজ করে গেছেন। সে কারণেই হয়তো পিতামাতার পরেই শিক্ষকের অবস্থান।

২০২৪ সালে যে পরিমাণ শিক্ষক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও নেই। আর এর বেশিরভাগই ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা হয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়ার ভিডিও ফুটেজ ও পত্র-পত্রিকার তুলে ধরা শিক্ষক লাঞ্ছনার ভয়ঙ্কর রূপ দেখা যায় গত ৫ আগস্ট পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে। জুতার মালা, শিক্ষককে মারধর, পদ দখল, শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করাসহ অসংখ্য ঘটনা ঘটিয়েছেন এই তথাকথিত মেধাবী শিক্ষার্থী প্রজন্ম। শিক্ষক সমাজ কেন এত নিগৃহীত ও অবহেলিত? তার কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার পাহাড় সমান বৈষম্য। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অপ্রতুল বাজেট, অস্থায়ী শিক্ষা নীতমালা প্রণয়ন, নিয়োগ বাণিজ্য, প্রশিক্ষণ, পাঠ্যক্রম, শ্রেণীকরণ, বেতন-ভাতা, অবকাঠামো, লেজুড়বৃত্তি, শিক্ষক পরিচালনা পর্ষদের দৌরাত্ম, রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নসহ নানা আকাশচুম্বী বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া নিজেদের বিভ্রান্ত, বিভক্তি বিষে শিক্ষক সমাজ দিনে দিনে আরও বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। করোনাকালে বৈষম্য লক্ষ্য করা গেছে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ঢের বেশি।

বিশ্বব্যাপী মহামারী বা অতিমারীতে রুপ নেওয়া কোভিড-১৯ পরবর্তী সময় শিক্ষকদের পঠন-পাঠন কার্যক্রমে যথেষ্ঠ দক্ষতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। পরিবর্তিত পরিবর্তনে শিক্ষকদের মাঝে দক্ষতার অভাব যেমন ছিল, তেমনি ছিল বেতন-ভাতাহীন মানবেতর জীবনযাপন। কথায় আছে, ‘পেটে খেলে পিঠে সয়।’ শিক্ষক যেখানে খেতে পায় না সেখানে মানের কথা তো অলীক স্বপ্ন মাত্র।

শিক্ষকের মান শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ২০২৪ এর পট পরিবর্তন পরবর্তী বাজেট আরও বেশি ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। গত ২ অক্টোবর রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সম্প্রতি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রেক্ষাপটে ‘বৈষম্য দূরীকরণে শিক্ষায় নিরবচ্ছিন্ন রুপান্তর: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ শীর্ষক পলিসি ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। এতে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও অ্যাডুকেশন ওয়াচের সদস্য সচিব রাশেদা কে চৌধুরীর বক্তব্যে বেরিয়ে এসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরবর্তী সময়ে শিক্ষা খাতের বৈষম্য। তারা শিক্ষাক্ষেত্রে জিডিপি বাড়িয়ে ৪ শতাংশ রাখার দাবি করেছেন।

বিগত বাজেটগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মোট বাজেটের ১২ শতাংশ ও মোট জিডিপির  ২.১০ শতাংশের কাছাকাছিই থেকেছে বাংলাদেশের শিক্ষা বরাদ্দ। যেখানে ডাকার তথ্য ও ইউনেস্কো স্বীকৃত আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসারে কোনো দেশের মোট বাজেটের ২০ শতাংশ ও জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। এই স্বল্প বাজেটে শিক্ষা কাঠামো ও পরিবেশের পাশাপাশি শিক্ষকদের মান কতটা ধরে রাখা সম্ভব তা প্রশ্ন থেকেই যায়।

শিক্ষকদের শ্রেণী বৈষম্যের চিত্র আরও ভয়াবহ। বিসিএস, এমপিও, এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে ননএমপিও, ননএমপিও প্রতিষ্ঠানে ননএমপিও, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক প্রভৃতি শ্রেণী বৈষম্যও শিক্ষক বৈষম্যের একটি মূল কারণ। অন্য একটি কারণ হল, উচ্চশিক্ষা স্তরে শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:২০ হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশে তার ধারে কাছেও নেই। আর এতে করে দেখা যায় বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেতন বৈষম্য পাহাড় সমান।

সম্প্রতি বেতন বৈষম্য সম্পর্কে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কর্মরত বিভিন্ন শিক্ষকের বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেন। এমনই একটি শিক্ষক শ্রেণী হল বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক যারা দীর্ঘ তিন দশকের অধিক সময় ধরে নামমাত্র বেতন ২-৫ হাজার টাকায় শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে মানবেতরভাবে যুগের পর যুগ। 

জাতিসংঘ নির্ধারিত সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের (এসডিজি) ১৭টি লক্ষ্য বা সূচকের চার নম্বরে মানসম্পন্ন শিক্ষার কথা বলা হয়েছে।  আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, বাংলাদেশ ইতোপূর্বে জাতিসংঘের ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’ গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া সবসময়ই বাঙালী জাতির একটি অনন্য অহংকারের দাবি ছিল মানসম্মত শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন। শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ শিক্ষকদের একমাত্র সময়ের দাবি। শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগে করতে হবে এবং জাতিসংঘের অংশীদারিত্ব ও প্রয়োজনীয় সম্পদ নিশ্চিতকরণে কাজ করতে হবে কর্তাব্যক্তিদের।‌

আমাদের শিক্ষার বড় বড় কর্তাব্যক্তিরা তাদের ভাষণে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে স্টোয়িক দর্শনের পরিচয় দিলেও জনকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সন্তানের ঠিকুজিকোষ্ঠী উদ্ধারে ব্যস্ত থাকেন সবসময়ই। আর অবোলা শিক্ষক সমাজ ‘সিনিক’ সেজে মুক্তির প্রহর গুণে চলে যান নিরন্তর। তবে কি মিলবে মুক্তি, নাকি খুঁজবে ভাঁড়ামি যুক্তি আর বাড়বে তোষামোদি ভক্তি?

লেখক: প্রভাষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, আলহাজ্ব সারোয়ার খান ডিগ্রি কলেজ, সেনহাটি, দিঘলিয়া, খুলনা