ক্যাম্পাস

যেমন ক্যাম্পাস চান চবি শিক্ষার্থীরা

দ্বিতীয় স্বাধীনতার পর নতুন ভাবে বিনির্মাণ হচ্ছে বাংলাদেশ। শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশবাসী পেয়েছে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। তাই শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, ক্যাম্পাসগুলো তাদের স্বপ্নের মতো গড়ে ওঠবে। কেমন ক্যাম্পাস চান চবি শিক্ষার্থীরা?- এ প্রশ্নের জবাবে নানা প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীরা। রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য তাদের প্রত্যাশা ও ভাবনার তুলে ধরা হলো।

ছাত্র রাজনীতি থাকবে চাকসুভিত্তিক

বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে নানামুখী গবেষণা ও চিন্তা চেতনার জন্য উন্মুক্ত উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেখানে ছাত্ররা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ পরিচালনা করার মাধ্যমে দেশ ও জাতির কল্যাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। কিন্তু বিগত স্বৈরশাসকের আমলে এ সব কার্যক্রমের যথাযথ পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। এখন আমরা এমন একটি ক্যাম্পাস চাই, যে ক্যাম্পাসে থাকবে উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি গবেষণা, ডিবেটিং ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। ক্যাম্পাসে থাকবে সুস্থধারার ছাত্র রাজনীতি, যে রাজনীতি হবে না কোনো লেজুড়বৃত্তিক, থাকবে না কোনো তৈলাক্ততার সমাবেশ।

ক্যাম্পাসে থাকতে হবে চাকসুভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি, যার মাধ্যমে ছাত্ররা তাদের অধিকার আদায় করতে পারবে। ক্যাম্পাস হোক আধিপত্যবাদ মুক্ত, সম্পূর্ণ স্বাধীন। পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা সামাজিক কাজ চালিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু কেউ কাউকে বাধা দিবে না। লাইব্রেরির যথাযথ সংস্কার এনে গবেষণার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে, হল ভিত্তিক ডিবেটিং ক্লাব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ সব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে চবিয়ানরা সুন্দর একটা ক্যাম্পাস উপহার পাবে বলে আশা করি। (লেখক: সাকিব উল্লাহ, শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ, আরবি সাহিত্য বিভাগ)

ট্রেনের শিডিউল বৃদ্ধি ও বাস চালু করতে হবে

বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্যই হলো জ্ঞানের উন্মুক্ত চর্চা ও জ্ঞান সৃজন, সঙ্গে প্রয়োজন এ লক্ষ্য অর্জনে অত্যাবশকীয় অবকাঠামো। আমি চাই আমার ক্যাম্পাস জুড়ে জ্ঞানের বাধাহীন চর্চা হবে। কেন্দ্রীয় এবং বিভাগীয় লাইব্রেরিগুলো হবে যথাসম্ভব উন্মুক্ত। পাঠচক্র, আলোচনা চক্র, সাহিত্য সভাসহ জ্ঞান চর্চায় সহায়ক নানা কার্যক্রম চলবে ক্যাম্পাস জুড়ে। স্টেশন ও ঝুপড়িতে শিক্ষার্থীদের আড্ডার একটা অংশ জুড়ে থাকবে জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়। অবকাঠামোর দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হবে মানসম্পন্ন। সব ক্লাসরুমে থাকবে উন্মুক্ত ইন্টারনেট, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও ভালো সাউন্ড সিস্টেম এবং ওয়াশরুমগুলো হবে স্বাস্থ্যসম্মত।

জ্ঞান অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের মৌলিক চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করা অপরিহার্য। এজন্য হলের আবাসন সুবিধা বৃদ্ধিকরণের পাশাপাশি প্রয়োজন ডাইনিংয়ের খাবারের মান উন্নত করা, যা পুষ্টির চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। মেডিক্যাল সেন্টারে প্রয়োজন উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা।

চবি শিক্ষার্থীদের অন্যতম ভোগান্তির উৎস হল এর যাতায়াত ব্যবস্থা। এ ভোগান্তি নিরসনে প্রয়োজন শাটল ট্রেনের শিডিউল বৃদ্ধিকরণ ও চবির নিজ উদ্যোগে ক্যাম্পাস টু শহর বাস সার্ভিস চালু। ক্যাম্পাসের যাবতীয় দাপ্তরিক কাজ অনলাইনে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সব ধরনের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করে একটি সুষ্ঠু, নিরাপদ ও শিক্ষাবান্ধব ক্যাম্পাস চাই আমি। (লেখক: জয়নুল আবেদীন ফাহিম, শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ)

ক্যাম্পাস হোক জ্ঞানের উন্মুক্ত ভান্ডার

বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় বিশ্ব জ্ঞানের ভান্ডার, যেখান থেকে প্রতিনিয়ত অর্জন করা যায় নানাবিধ অভিজ্ঞতা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি চাই, আমার ক্যাম্পাস হোক জ্ঞানের সেই উন্মুক্ত ভান্ডার, যেখানে আমরা পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাব। 

আমার স্বপ্নের ক্যাম্পাস হবে এমন একটি স্থান, যেখানে থাকবে না কোনো বৈষম্য, নোংরা রাজনীতি, দুর্নীতি। আর থাকবে না শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যাংকিং থেকে শুরু করে আমাদের সব সেবা হবে আধুনিক এবং ডিজিটাল। 

পড়াশোনার পাশাপাশি আমাদের অংশ থাকবে গবেষণা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। গবেষণার জন্য থাকবে উন্নত ল্যাবরেটরি, পর্যাপ্ত তহবিল এবং আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা। আমাদের ক্যাম্পাস হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সবুজে ঘেরা এবং পরিবেশবান্ধব। নিরাপত্তার জন্য থাকবে আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য থাকবে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। সর্বোপরি, একটি বৈষম্যবিহীন, দুর্নীতিমুক্ত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও শিক্ষার মানে এগিয়ে থাকা ক্যাম্পাসই চাই, যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থী তার পূর্ণ সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ পাবে। (লেখক: সানু আক্তার নদী, শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ, ফাইন্যান্স বিভাগ)

বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসার মান শিক্ষার্থীদের কাছে স্বস্তিদায়ক নয়

পৃথিবীর সব পরিবর্তন কিন্তু সুখকর হয় না। কিছু পরিবর্তন বেদনাদায়কও হয়। শত শত শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশে আমরা চাই পরিবর্তনটা সুখকর হোক। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, ‘দেশ ভালো হয়, যদি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়।’ সেই সুবাদে বলা যায় আমাদের বিশ্বিবিদ্যালয়গুলো যদি ভলো হয়, তাহলে আমরা একটি ভালো দেশ উপহার পেতে পারি।

কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বিগত সময়গুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় রাজনীতির প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। ইতোমধ্যেই আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশের অন্তবর্তীকালীন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে দলীয় রাজনীতি থেকে বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং গবেষণা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে গবেষণার প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। দেশের অন্যতম বৃহৎ ও স্বায়ত্তশাসিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এ ব্যবস্থা না থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। এছাড়াও, অতিদ্রুত চবি লাইব্রেরির পুরাতন পদ্ধতিগুলো সংস্কার করে শিক্ষার্থীদের সন্তুষ্টির সঙ্গে পড়াশোনার সুযোগ করে দিতে হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়ন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান চিকিৎসাসেবার মান কোন শিক্ষার্থীর নিকট স্বস্তিদায়ক বলে মনে হয় না। (লেখক: মনসুর আলম, শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ)

হলে খাবারের মান বৃদ্ধি করতে হবে'

ক্যাম্পাসে আসার এক বছর পূর্ণ হলেও, বিভিন্ন বিষয়ে অনেক সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রথমেই যদি বলতে হয়, নিরাপদ ক্যাম্পাস সবারই চাওয়া। সে ক্ষেত্রে, লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির কারণে নির্দিষ্ট কোনো দলের আধিপত্য বিস্তার কারোরই কাম্য নয়। বরং ছাত্র সংসদ গঠনের মাধ্যমে ছাত্র-অধিকার নিশ্চিত হওয়া চাই।

আবাসন সংকটের পাশাপাশি হলের ডাইনিংয়ের খাবারের মান খুবই নিম্নমানের ও অনুপযোগী। এ ক্ষেত্রে, হল প্রাধ্যক্ষদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। শাটলের শিডিউল বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্যাম্পাসে চক্রাকার বাস চালু করা এখন সময়ের অন্যতম দাবি। কারণ, অনেক শিক্ষার্থী আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও হলে পর্যাপ্ত পরিমাণ সিট না থাকায় তারা বাহিরে বিভিন্ন কটেজ বা বাসায় অবস্থান করছেন। তাদের বাসা বা কটেজ ভাড়া ও অন্যান্য খরচের পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ যাতায়াত খরচ, যা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানকল্পে চবি প্রশাসন প্রাথমিক যে পদক্ষেপ নিতে পারে, তা হলো- সকাল ৮.৩০ থেকে ৯.৩০ এবং দুপুর ১২.৩০ থেকে ২.৩০ পর্যন্ত ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে সব রুটে চক্রাকার বাস চালু করতে পারে। চবি প্রশাসন এ সব সংকট থেকে উত্তরণের উপায় দ্রুততম সময়ে বের করবেন বলে আশা করি। (লেখক: মিফতাহুল আবেদীন আশিক, শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ, আরবী সাহিত্য বিভাগ)

দ্রুত চাকসু নির্বাচন দিতে হবে

হাজার হাজার ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশের রূপান্তর হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের পতন ঘটে। স্বৈরাচারীর পতনের পর বাংলার জনগণ তাদের বাক-স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা গেছে রাজনৈতিক সচেতনতা।

গত প্রায় ১৬ বছর ধরে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল স্বৈরাচারের দোসর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তার মধ্যে অন্যতম। রাষ্ট্রের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। তেমনি একটি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। রাষ্ট্রের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারে হাত দিয়েছেন নবনিযুক্ত প্রশাসন। অল্প কয়েকদিনে তাদের কার্যক্রমের মানোন্নয়নের জন্য প্রশংসার দাবি রাখে।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের কিছু দাবি রয়েছে। যেমন- বিভাগগুলোকে সম্পূর্ণ সেশনজট মুক্ত করা; ক্যাম্পাসকে র‍্যাগিং মুক্ত রাখা; শাটলের বগি ও সিডিউল বাড়ানো; সম্পূর্ণ মাদকমুক্ত ক্যাম্পাস ঘোষণা করা; সুস্থ ধারার রাজনৈতিক চর্চায় এবং শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে দ্রুত চাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা; ক্যাম্পাসকে সর্বদা পরিচ্ছন্ন রাখা এবং ক্যাম্পাসের আশেপাশে ঝুপড়ি ও  হোটেলগুলোতে নিয়মিত মনিটরিং করা; শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে অনলাইন ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু করা; ক্যাম্পাসকে শিক্ষার্থীবান্ধব এবং গবেষণার পরিবেশ তৈরি করা।

এ সব দাবি পূরণের মাধ্যমে আমাদের স্বপ্নের ক্যাম্পাস স্বপ্নের মতোই গড়ে ওঠুক, এ প্রত্যাশা করি। (লেখক: মো. নাজমুল হাসান, শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, ইতিহাস বিভাগ)