ক্যাম্পাস

শিক্ষার্থীবান্ধব ও বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সময়ের দাবি

শিক্ষা হলো জ্ঞানলাভের একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া এবং ব্যক্তির সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলির পূর্ণ বিকাশের জন্য তাকে উৎসাহ দেওয়া হয় এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা হয়।

সাধারণ অর্থে দক্ষতা বা জ্ঞান অর্জনই হলো শিক্ষা। বাংলা ‘শিক্ষা’ শব্দটি এসেছে ‘শাস’ ধাতু থেকে, যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দেওয়া। অন্যদিকে, ইংরেজি ‘অ্যাডুকেশন’ শব্দটি এসেছে লাতিন ‘অ্যাডুকেয়ার’ বা ‘অ্যাডুকাতুম’ থেকে, যার অর্থ হলো ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা।

কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা একজন ব্যক্তির পরিপূর্ণ বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে শিক্ষার সব স্তরে শিক্ষার্থীরা নানামুখী সংকটে পড়ছেন। আমাদের দেশে যে চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল এবং বিগত দশকগুলোতে যে ধারার সঙ্গে পরিচিত ছিল, করোনাভাইরাসের কারণে তাতে ব্যাপক নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিকতায় শিক্ষাব্যবস্থার ধরন ও স্বরূপ পরিবর্তিত হলেও এবং আধুনিকায়নের পথে এগোলেও করোনা মহামারীর পর শিক্ষাব্যবস্থায় কিছুটা  সংকটপূর্ণ অবস্থা তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।

২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন এসেছে। সরকারের পতন এবং মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার পর নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হলেও, শিক্ষা খাতের সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবচেয়ে বেশি সমস্যা দেখা যাচ্ছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংকট সমাধানে বিভিন্ন মহল থেকে কাজ করা হলেও, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমস্যাগুলো সমাধানে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে এবং তাদের শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৬৯টি, এর মধ্যে ১১৪টি বেসরকারি এবং ৫৫টি সরকারি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৭ লাখেরও বেশি। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৬০-৭০ শতাংশই নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা তাদের জন্য আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক ক্ষেত্রেই এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান পড়াশোনার পদ্ধতি শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো অনেক শিক্ষার্থী তাদের অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকটের কারণ হিসেবে শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রিত ধারাবাহিক শিক্ষা পরিবেশের  অভাব অন্তরায় হয়ে কাজ করছে। উপাচার্যদের পদত্যাগসহ প্রশাসনিক অস্থিতিশীলতা ও শিক্ষকদের দায়বদ্ধতার অভাবের কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত ল্যাব ও গবেষণার সুযোগ না থাকায় শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।

এছাড়াও, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি, যৌন সহিংসতা ও প্রশাসনিক অস্থিরতা এ সংকটের জন্য অনেকাংশেই দায়ী। এ সব কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করে বরং অসহায় বোধ করছে।

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা সংকট নিরসনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি'র) উচিৎ, প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সৎ, যোগ্য ও শিক্ষার্থীবান্ধব উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া। পাশাপাশি বেসরকারি ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য দূর করে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত ল্যাব, গবেষণার সুযোগ ও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করাও অত্যাবশ্যক।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং শিক্ষার্থীদের দ্রুত ক্লাস ও পরীক্ষায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। যদিও এ সংকট একদিনে দূর হবে না, তবে রাষ্ট্র ও সমাজ যদি শিক্ষার উন্নয়নে সংকল্পবদ্ধ হয়, তাহলে এ সংকট স্বল্প সময়ে দূর করা সম্ভব। কারণ শিক্ষা হচ্ছে বিনিয়োগের সর্বোত্তম জায়গা, যার সুফল পুরো দেশ ভোগ করে।

বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষা ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার আনা না হলে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটতে থাকবে এবং দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। তাই শিক্ষার্থীবান্ধব, নিয়ন্ত্রিত ও বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম