ক্যাম্পাস

গরুর দুধে পাওয়া যাচ্ছে ইনসুলিন

ইনসুলিন একটি হরমোন, যার অভাব (টাইপ-১) বা ইনসুলিন রেজিজট্যান্স (টাইপ-২) ডায়াবেটিসের মূল কারণ। এটি গ্লুকোজের একটি দীর্ঘস্থায়ী বিপাকীয় রোগ, যা দেহের একাধিক অঙ্গকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

টাইপ-১ ডায়াবেটিসে সাধারণত অগ্নাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যান্সের বিটা কোষের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ইনসুলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং রক্ত ও প্রসাবে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। টাইপ ২ ডায়াবেটিসে, ইনসুলিনের রিসিপ্টরগুলো কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। যার পটভূমিতে বিটা কোষ দ্বারা ইনসুলিন ক্ষরণের প্রগতিশীল ক্ষতি হয়, ফলে রক্তে উচ্চ শর্করা দেখা যায়। 

এভাবে, বিটা কোষ ইনসুলিন প্রতিরোধের ক্ষতিপূরণের জন্য ইনসুলিন ক্ষরণ বাড়ায়, ফলে রক্তের প্লাজমাতে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ে। ডায়াবেটিস হল বিশ্বের দ্রুততম বৃদ্ধি পাওয়া স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থাগুলোর মধ্যে একটি। ২০২১ সালে আনুমানিক ৫৩৭ মিলিয়ন মানুষের ডায়াবেটিস ছিল, যা ২০৪৫ সালের মধ্যে ৭৮৩ মিলিয়নে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ, যেখানে শরীরের ইনসুলিন উৎপাদন ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি নিরাময়ের জন্য ইনসুলিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হরমোন। টাইপ-১ ডায়াবেটিসের প্রধান চিকিৎসা হচ্ছে দেহে কৃত্রিমভাবে ইনসুলিন সরবরাহ করা। ফলে বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগের বৃদ্ধি এবং এর চিকিৎসার জন্য কৃত্রিম ইনসুলিনের ব্যাপক চাহিদা পূরণ করতে নতুন উদ্ভাবন এবং গবেষণা অত্যন্ত জরুরি।

ইনসুলিনের সরবরাহ বাড়াতে গবেষকরা এক নতুন পদ্ধতির দিকে নজর দিয়েছেন। তা হলো- ট্রান্সজেনিক বা জেনেটিকভাবে প্রক্রিয়াজাত গরুর দুধ থেকে মানব প্রোইনসুলিন উৎপাদন।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের একদল গবেষকের ট্রান্সজেনিক গবাদি পশুর দুধে মানব প্রোইনসুলিন উৎপাদন সংক্রান্ত একটি গবেষণা পত্র জনপ্রিয় ‘বায়োটেকনোলজি জার্নাল’ এ প্রকাশিত হয়েছে।

ওই গবেষণা পত্রে বলা হয়, বর্তমানে বায়োটেকনোলজি এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন উপায়ে কৃত্রিম ইনসুলিন তৈরি করা হয়। তবে এর উৎপাদন সীমিত ও ব্যয়বহুল। এ সীমাবদ্ধতা কাটাতে এবং ইনসুলিনের চাহিদা পূরণ করতে বিজ্ঞানীরা ট্রান্সজেনিক পশুদের ব্যবহারের দিকে মনোনিবেশ করেছেন।

গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে তৈরি করা একটি কৃত্রিম লেন্টিভাইরাস, যা গরুর β-ক্যাসিন প্রোমোটার এবং মানব ইনসুলিন সিকোয়েন্স ধারণ করে। এটি ব্যবহৃত হয়েছিল প্রাপ্তবয়স্ক ফাইব্রোব্লাস্ট উৎপাদনের জন্য এবং এ কোষগুলোকে নিউক্লিয়ার ট্রান্সফারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। এ কোষগুলো পরে ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে গরুর দেহে প্রবেশ করানো হয় এবং সফলভাবে একটি ট্রান্সজেনিক বাছুর জন্ম দেওয়া হয়। এ বাছুরটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে তার দুধে মানব প্রোইনসুলিন তৈরি হয় এবং দুধের প্রোটিয়াসগুলোর মাধ্যমে ইনসুলিনে রূপান্তরিত হতে পারে।

গবেষণার ফলাফল হিসেবে, ট্রান্সজেনিক গরুর দুধে মানব ইনসুলিনের পূর্ববর্তী ধাপ প্রোইনসুলিন এবং ইনসুলিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে, ইনসুলিন উৎপাদনের মাত্রা কম ছিল এবং দুধের কিছু প্রোটিয়াস ইনসুলিনকে ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। 

যদিও ইনসুলিনের উৎপাদন কম। কিন্তু এটি একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় উদ্ভাবন হিসেবে দেখা যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সুলভে ইনসুলিন সরবরাহের নতুন পথ খুলে দিতে পারে।

এ গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, গরুর দুধের মাধ্যমে ইনসুলিন উৎপাদন করা সম্ভব। এটি ডায়াবেটিস চিকিৎসায় এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তবে, ইনসুলিনের উৎপাদনের মাত্রা বাড়ানোর জন্য আরও গবেষণা এবং উন্নয়ন প্রয়োজন। ভবিষ্যতে এ পদ্ধতিটি বিশ্বব্যাপী ইনসুলিনের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

ট্রান্সজেনিক গরুর দুধ থেকে মানব ইনসুলিন উৎপাদন একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় পদ্ধতি, যা ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটাতে পারে। গবেষণা চলতে থাকলে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নতি করা গেলে, এটি ইনসুলিন উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি কার্যকর এবং সাশ্রয়ী সমাধান হতে পারে।