ক্যাম্পাস

প্রথম ছাত্রী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলেন খুমি সম্প্রদায়ের তংসই

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) চলতি শিক্ষাবর্ষে নৃবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছেন তংসই খুমি নামে পাহাড়ের খুমি সম্প্রদায়ের এক মেয়ে। তিনি খুমি সম্প্রদায় থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রথম ছাত্রী বলে জানা গেছে।

তংসই খুমি চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়। তার দুই ভাইও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তার বড় ভাই সুইতং খুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাফিক ডিজাইন বিষয়ে মাস্টার্সে এবং আরেক ভাই তংলু খুমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত। সবার ছোট বোন রেংসই খুমি ঢাকার সেন্ট যোসেফ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্রী।

তার গ্রামের বাড়ি বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় তারাছা ইউনিয়নের দুর্গম মংঞো পাড়ায়। বান্দরবান সদর থেকে সাঙ্গু নদীই সেখানে যাওয়ার একমাত্র পথ।

তিনি বান্দরবান কালেক্টর স্কুল থেকে প্রাইমারি শেষ করে বান্দরবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।  এসএসসি পাশের পর তিনি ভর্তি হন ঢাকা হলিক্রস কলেজে। প্রাইমারি শেষ করার আগেই ২০১৪ সালে তার বাবা নয়লো খুমি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

এই নয়লো খুমি ছিলেন খুমি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম সরকারি চাকরিজীবী। তিনি জেলার তারাছা ইউনিয়নের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

১০ বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে চার ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচসহ সংসারের যাবতীয় চাহিদা মেটান তাদের মা। ঘরের কোমর তাঁতে বোনা খুমিদের ঐতিহ্যবাহী পোষাকই তংসইয়ের মায়ের একমাত্র আয়ের উৎস। তাঁতে এসব পোশাক তৈরির পর স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে যা আয় হয়, সেটা দিয়েই চলে চার ভাই-বোনের লেখাপড়া ও সংসার খরচ।

তংসই খুমি বলেন, ‘বাবা যখন মারা যান, তখন আমি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। বাবা মারা যাওয়ার পর ভেবেছিলাম, হয়তো দুই বোনের আর পড়াশোনা হবে না। পরিবার বোধহয় কোনোভাবে দুই ভাইকে পড়াবে। বাবা মারা যাবার পর কিছুদিন আমাদের দাদুবাড়ি থেকে পড়াশোনার জন্য সহায়তা করা হতো। পরে মা তাঁত বোনার কাজ শুরু করেন।’

আগমী ৩ নভেম্বর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ক্লাস শুরু হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই পর্যন্ত আসার পেছনে একমাত্র অবদান মায়ের। মা শুধু ভাইদের পড়াশোনা না, আমরাও যাতে পড়াশোনা করি সে ব্যাপারে সজাগ ছিলেন, সচেতন ছিলেন। ফলে সব ধরনের কৃতজ্ঞতা মায়ের প্রতিই। তিনি না থাকলে এতদূর আমারা আসতে পারতাম না।’

বান্দরবানের পাহাড়ি খুমি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা খুবই কম। এ অনগ্রসর সম্প্রদায়ে নারীরা অনেক পিছিয়ে। ফলে বড় হতে হতে মেয়েরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। তাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা আছে তংসই খুমির। শুধু খুমিদের জন্য নয়, আগামী দিনে অনগ্রসর জাতি-গোষ্ঠী নিয়ে কাজ করতে চান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তংসই খুমির বড় ভাই সুইতং খুমি বলেন, ‘মা বান্দরবান শহরে উজানী পাড়ায় থাকেন। ঘরে কোমর তাঁতে খুমিদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক তৈরি করেন। সেগুলো বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে লেখাপড়ার খরচ চলে। আর আমি নিজেও বাইরে গ্রাফিক ডিজাইনের উপর পার্টটাইম চাকরি করি। আমার ও মায়ের আয় দিয়ে বাকি ভাই-বোনের লেখাপড়া ও সংসার খরচ চলছে।’

খুমিদের সামাজিক সংগঠন খুমি সোস্যাল কাউন্সিলের সভাপতি সিঅং খুমি জানান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন খুমি ছাত্রী পড়লেও তংসই খুমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। খুমিদের বেশির ভাগ মানুষ দুর্গম এলাকার বসবাস করে। আর্থ-সামাজিক এবং বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় কেউ চাইলেই এত সহজে উচ্চশিক্ষায় আসতে পারে না। তংসই খুমির বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হওয়া অন্যান্য শিক্ষার্থীর উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানান তিনি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে কম ভাষিক ও বিপন্ন জনগোষ্ঠী হলেন খুমি জনগোষ্ঠীরা। সরকারি হিসাবে ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী তাদের জনসংখ্যা ৩ হাজার ৯৯৪ জন। শুধু বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলায় তারা বসবাস করেন।