উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পড়াশোনার সুযোগ এখন বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা। তবে এ যাত্রায় সফল হতে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতা। শিক্ষার্থীদের জন্য সেই নির্ভরতার স্থান হয়ে উঠেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হায়ার স্টাডি ক্লাব (জেইউএইচএসসি)।
সুচনালগ্ন থেকেই এ ক্লাব উচ্চশিক্ষা বিষয়ক যাবতীয় তথ্য ও শিক্ষা উপকরণ দিয়ে জাবি শিক্ষার্থীদের সাহায্য করে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষার পথ সহজ করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা এবং আগ্রহী শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পূরণের প্রেরণা ও সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৪১তম আবর্তনের শিক্ষার্থী সাজিদ কামাল যখন উচ্চশিক্ষার জন্যে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন বিদেশে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক সঠিক তথ্যের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই পরামর্শদাতা অফিসগুলোর পেছনে প্রচুর টাকা ব্যয় করেন। কেউ প্রতারিতও হন। আবার ইন্টারনেটেও অনেক সময় পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় না। এ সব বিষয় চিন্তা করে তিনি চেয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি কমিউনিটি থাকবে, যেখানে সবার চিন্তা ও মননে লক্ষ্য থাকবে একটাই- উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে যাওয়া।
এ চিন্তা থেকে সাজিদ কামাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আমরাই জাহাঙ্গীরনগর’ ফেসবুক গ্রুপে একটা পোস্ট দেন এবং সেখানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী সাড়া দেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি এবং তার সহযাত্রীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি হায়ার স্টাডি ক্লাব (জেইউএইচএসসি)।
২০১৯ সালের ১৫ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র থেকে নিবন্ধন পায় ক্লাবটি। ক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালিত সভাপতি হন সাজিদ কামাল। তার সঙ্গে সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আবু সায়েম রিমন, হুমায়রা বিনতে আফরান, ঈশিতা কবির তন্বীসহ অনেকে ক্লাবটিকে নিয়ে যান অন্যন্য উচ্চতায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এ ক্লাবের মূল উদ্দেশ্য হলো, শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা প্রদান করা। ক্লাবটি শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করেছে একটি সহযোগিতামূলক পরিবেশ, যেখানে তারা বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগগুলো আবিষ্কার এবং অর্জনের জন্য আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।
ক্লাবটির কার্যক্রম সম্পন্নে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন অনুযায়ী সাজানো হয়েছে। এর কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, সেমিনার ও মেন্টরশিপ সেশন। যেখানে আইইএলটিএস, জিআরই টোফেলের মতো আন্তর্জাতিক পরীক্ষা প্রস্তুতি থেকে শুরু করে স্কলারশিপ আবেদন, ভিসা প্রক্রিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ক্লাবের মূল লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার প্রতিটি ধাপেই পাশে থাকা।
সপ্তাহের প্রতি রোববার আইইএলটিএস মডিউলের আদলে ইংরেজি চর্চা করা হয়। যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ইংরেজি দক্ষতাকে আরও মজবুত করতে সক্ষম হন।
ক্লাবটির অন্যতম প্রধান উদ্যোগ হচ্ছে হায়ার স্টাডি ৩৬০°। এটি একটি বার্ষিক বিশেষ অনুষ্ঠান যেখানে বিদেশে উচ্চশিক্ষায় সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীরা তাদের অভিজ্ঞতা এবং পরামর্শ ভাগাভাগি করেন। এছাড়াও যে সব সংস্থা বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে কাজ করেন, তারা উচ্চশিক্ষার নানা দিক তুলে ধরেন শিক্ষার্থীদের কাছে। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং পরামর্শের ভিত্তিতে নিজেদের উচ্চশিক্ষার পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পান।
এছাড়াও, জেইউএইচএসসি নিয়মিতভাবে আয়োজন করে বিভিন্ন সেমিনার, ওয়েবিনার ও ইন্টারেকটিভ সেশন, যেখানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষা পরামর্শকগণ। যা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা ও স্কলারশিপ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রাপ্তির মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।
জেইউএইচএসসির ধারাবাহিক কার্যক্রমের একটি মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম, যা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণের পথে বিশেষভাবে সাহায্য করছে। অভিজ্ঞ গবেষক এবং পেশাজীবীদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জুটি বেঁধে ক্লাবটি ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ প্রদান করে।
সম্প্রতি ফ্যাল ২০২৫-এর জন্য একটি মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করেছে, যেখানে ২৫০টি আসন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আবেদনকারীদের আইইএলটিএস প্রস্তুতির উপর ভিত্তি করে যোগ্যতা নির্ধারণ করে শিক্ষার্থীদের বাছাই করা হয়। এর মাধ্যমে যারা সত্যিই উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাদের জন্য কার্যকরি সহায়তা প্রদান করা যায়। একইসঙ্গে তাদের মেন্টরিংয়ের জন্য বিভিন্ন সেশনের আয়োজন করা হয়, এর মাধ্যমে তারা জানতে পারেন- কবে, কোন কাজগুলো করলে তারা অন্যদের থেকে একধাপ এগিয়ে থাকবেন।
এছাড়া আন্তর্জাতিক শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের মান উজ্জ্বল করছেন জাবির এমন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ক্লাবের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছেন। তাদের সঙ্গে ক্লাবটি একটি শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। ফলে এ সব প্রাক্তনরা ক্লাবের বিভিন্ন কার্যক্রমে অতিথি বক্তা বা মেন্টর হিসেবে নিয়মিত যুক্ত হন। এ সব প্রাক্তনদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সাজিদ কামাল, সহ-প্রতিষ্ঠাতা আবু সায়েম রিমন, হুমায়রা বিনতে আফরান, ঈশিতা কবির তন্বী, উপদেষ্টা শান্ত রায়, তনুশ্রী শার্মা, আফলাতুন কায়সার জিলানি, শেখ সানজানা রাতমী, খালেদ মাহমুদ খান, ফাইয়াদ এইচ রিসাল, গিয়াস আল ইবরার চৌধুরী, নাহিয়ান ইমতিয়াজ হাসান প্রমুখ।
গত দুই বছরে ক্লাবের ছয়জন সদস্য যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষায় ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গেছেন। এছাড়া ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা প্যানেলের সবাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন।
তবে জেইউএইচএসসি শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরই সহযোগিতা করছে না, পাশাপাশি দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও বিভিন্নভাবে সাহায্য করছে। ক্লাবের অ্যাপ্লিকেশন মেন্টরিং গ্রুপ ও ইউটিউব চ্যানেলের বিভিন্ন ওয়েবিনারে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হয়ে উপকৃত হচ্ছেন।
প্রতিবছর হায়ার স্টাডি প্রোগ্রাম আয়োজন করে থাকে এ ক্লাব। এ বছর আমেরিকান হাইকমিশনের পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক কাউন্সিলর স্টিফেন ইবেলি এসেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বিদেশ গমনে সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বাস দেন।
শিক্ষার্থীদের জীবনে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈশ্বিক যোগাযোগ স্থাপনে বিশেষ ভূমিকা রাখা এ ক্লাবটি ভবিষ্যতে আরও বেশি শিক্ষার্থীকে সহায়তা করতে এর কর্মসূচি সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা করছে। ক্লাবের সদস্যরা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়িয়ে আরও উন্নত স্কলারশিপ ও সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করবেন বলে জানা গেছে।
এ সম্পর্কে ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ভূগোল ও পরিবেশ ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী ফাইয়াদ এইচ রিসাল বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হায়ার স্টাডি ক্লাব প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা বিষয়ক নানা গাইডলাইন ও মেন্টরিং দিচ্ছে। ফলে প্রতি বছর জাবি থেকে বাইরে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। এ সব শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দেশে শিক্ষা ও গবেষণায় কাজ করে যাচ্ছেন।
সাবেক সভাপতি ভূগোল ও পরিবেশ ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী খালেদ মাহমুদ খান বলেন, ‘জেইউএইচএসসি আমার জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা। এটা আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করেছে এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। দক্ষতা, প্রেরণা ও দিকনির্দেশনা— সব একসঙ্গে এখানেই পেয়েছি।’