ক্যাম্পাস

‘ছাত্র রাজনীতিকে মুরুব্বি মুক্ত করতে হবে’

বলা হয় মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী। ইতিহাসের সেই আদি থেকেই চলেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। ২০২৪ এ ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকেই অংশীজনদের মধ্যে সরব আলোচনা চলেছে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে। কখনও দাবি উঠেছে নিষিদ্ধের, কখনও-বা আংশিক বর্জনের। সে সব দোলাচাল ভেদ করতে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে মতামত জানতে চায় রাইজিংবিডি। তাদের সবাই ছাত্র রাজনীতিকে মুরুব্বি মুক্ত করার পক্ষে মতামত দিয়েছেন।

ছাত্র-রাজনীতির আমূল সংস্কার জরুরি

ছাত্রজীবন মানুষের জীবনের স্বর্ণ সময়। ছাত্ররাই আগামীর কান্ডারি। কবি হেলাল হাফিজ বলেছেন, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁকেবাঁকে ছাত্র সমাজের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। তবে বিগত শতাব্দীতে ছাত্র-রাজনীতির বীরসেনাদের গৌরবগাঁথা এ শতাব্দীতে নব্য-ফ্রাংকেনস্টাইনে রূপ পরিগ্রহ করেছে। এ মুহূর্তে ছাত্র-রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেই দেশ রাহুমুক্ত হয়ে যাবে না। এখন ছাত্র-রাজনীতির আমূল সংস্কার জরুরি। তার আগে জরুরি জাতীয় রাজনীতির সংস্কার।

ছাত্র-রাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতি নিরবচ্ছিন্ন বিষয়। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত লেজুড়বৃত্তিক দলীয় রাজনীতি। এ লেজুড়বৃত্তিক দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে হবে। ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে মুরুব্বিদের হাজারও গাড়িবহরসহ প্রটোকলের বাসনা পরিহার করতে হবে। ছাত্র রাজনীতিকে অবশ্যই শতভাগ মুরুব্বিমুক্ত করে শুধু নিয়মিত ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রনেতাদের ছাত্রজীবনেই উচ্চাভিলাসী জীবনানন্দ পরিত্যাগ করে শিক্ষক রাজনীতির প্রভাব-বলয় মুক্ত হতে হবে। একইসঙ্গে ছাত্রদের কল্যাণার্থে গঠনমূলক রাজনীতি চর্চার পাশাপাশি বিপদ-শ্বাপদ-সংকট-সংকুলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের স্বার্থে নিয়োজিত হতে হবে। তাহলে ছাত্রদের হাতেই গঠিত হবে প্রত্যাশিত বৈষম্যহীন স্বপ্নের বাংলাদেশ। (লেখক: মো. আল-আমীন হুসাইন, প্রভাষক, রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাগ)

জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব সংকট তৈরি হয়েছে

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি থাকা উচিত কি-না, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বেই এ প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেছে। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬’র ছয় দফা, ১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং সদ্য সমাপ্ত ২০২৪’র ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিগত ৫ হাজার বছরের মধ্যে বাংলার সবচেয়ে বড় স্বৈরাচারের পতন। সব জায়গাতেই নেতৃত্বের সর্বাগ্রে ছিলেন ছাত্ররা। ছাত্র-জনতার সমান এত রক্তদান আর কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষই করেননি৷ এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও যে কোনো জরুরি বিষয়ে সবার আগে পথে নেমে এসেছেন এ ছাত্ররাই।

শিক্ষার্থীরা অধিকার ও রাজনীতি সচেতন না হলে আজকের এ সফলতা অর্জন করা অনেকটাই কঠিন হয়ে হতো। এমন গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস থাকার পরও কেউ যদি ছাত্র রাজনীতি থাকা-না থাকার দোলাচলে দুলতে থাকেন, তবে সেটা অনভিপ্রেত। তবে এটিই শেষ কথা নয়, আমাদের খুঁজে বের করতে হবে জনমনে ছাত্র রাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণা কেন তৈরি হলো। এর একটা বড় কারণ হলো, ছাত্র রাজনীতি তার পথ হারিয়েছে। ছাত্র রাজনীতিতে এখন রাজনীতির চেয়ে শতগুণ বেশি হয় তোষামুদি। দলের রাজনীতির চেয়ে ব্যক্তি রাজনীতি মূখ্য হয়ে গেছে। দেশের জন্য রাজনীতি করার চেয়ে নিজ ও দলের রাজনীতিই প্রধান হয়ে উঠেছে। নিকট অতীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলার লোক পাওয়া যায়নি ৷ প্রশাসনকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার সুযোগ কম ছিল।

জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব সংকট তৈরি হয়েছে। সংসদে একটা বড় অংশ ছিলেন ব্যবসায়ী। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দেশ সংস্কারের কার্যক্রম চলমান। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি থাকা-না থাকা বিষয়ে তারা কী ভাবছেন, সেটা আমরা এখনো জানি না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্পূর্ণ বিরাজনীতিকরণ করা হলে এর ফলাফল হবে ভয়াবহ। এ থেকে মুক্তির পথ হলো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি থাকতে হবে, তবে সেটি কোনো দলীয় ব্যানারে নয়। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ চালু করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নিষ্ক্রিয় আছে, সেগুলো সচল করতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আমাদের মেধাবী সন্তানেরা যেন আসতে পারে, সে পথ আমাদেরই তৈরি করে দিতে হবে। (লেখক: কাউছার আহমেদ, প্রভাষক, আইন বিভাগ)

রাজনৈতিক সংগঠনগুলো হয়ে উঠেছে সরকারের পকেট সংগঠন

বাংলায় ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এ রাজনীতির প্রসার শুরু হয় ১৯ শতকের গোড়ায়। রাজনীতির কেন্দ্রে তখন লেজুড়বৃত্তিক সিলসিলার বদলে শক্তিশালী ছিল অধিকার কেন্দ্রিক সচেতনতা। পেছনের সময়গুলোতে সংসদ কেন্দ্রীক রাজনীতি প্রখর ছিল। কোনো দলীয় কার্যে সোপর্দ হওয়া ছিল অযাচিত কাজ। কেননা তারা আভাস পেয়েছিলেন সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব রাজনৈতিক নেতাদের হাতে যেতে পারে। বলাই বাহুল্য, এ যাবৎ কালে বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠন পরিচালিত হয়ে আসছে রাজনৈতিক নেতাদের অধীনে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা এরশাদ বিরোধী আন্দোলন থেকে ২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, সবই শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। সবকিছুর কেন্দ্রে ওই অধিকার এবং অধিকারের জন্য লড়ে যাওয়া। প্রচলিত রাজনীতিতে কাঠামো বলে অবশিষ্ট কিছু নেই। দরকার যথাযথ বিনির্মাণ।

রাজনৈতিক সংগঠনগুলো হয়ে উঠেছে সরকারের পকেট সংগঠন, যত্রতত্র চাঁদাবাজি-রাহাজানি। ছাত্র রাজনীতির কেন্দ্র হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কারণ সেখানে ছাত্রদের অধিকার নিয়ে আলাপচারিতা চলবে, আন্দোলন হবে, শিক্ষার্থীরা শিখবে কি করে পরবর্তী জীবনে সম্পুর্ণ সম্মানপূর্বক কোনো প্রকার হিংস্রতা না দেখিয়ে দাবি আদায় করতে হয়। কিন্তু বর্তমান ছাত্র রাজনীতি অনেকটাই এর বিপরীতে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ চালু করে শিক্ষার্থীদের কাঠামোগত রাজনীতির সুযোগ দিতে হবে। যাতে পকেট রাজনীতি থেকে সমাজ মুক্ত হয়। (লেখক: তাওহীদ আহমদ সালেহীন, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ) 

ছাত্র রাজনীতিকে বিতর্কিত করেছে সন্ত্রাসীরা

ছাত্র রাজনীতি বললেও এর বিষয়বস্তু কেবল ছাত্রতেই সীমাবদ্ধ নেই, সমগ্র দেশ জুড়ে এর বিচারণ। ছাত্র-ছাত্রীদের যেকোনো স্বার্থে সদা তৎপর থেকে অধিকার আদায়ের পক্ষে আওয়াজ তোলাই মূলত ছাত্র রাজনীতি। ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন কেনো? একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ায় দেশব্যাপী ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। দেশের জনসংখ্যার ১০% হতদরিদ্র হওয়ায় এদের মধ্যে রাজনৈতিক জ্ঞান খুবই স্বল্প। বাংলাদেশে রয়েছে সুষ্ঠু রাজনৈতিক চেতনার অভাব, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অভাব ও নেতাদের ব্যক্তিস্বার্থ। এ সবের ফলশ্রুতিতে দেশে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে।

ছাত্র রাজনীতি দরকার। কেননা এটি ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক নেতার শাসন থেকে বাঁচার তাগিদ দেয়, নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার হতে শেখায়। দেশের মানুষকে প্রকৃত স্বার্থ আদায়ে আওয়াজ তুলতে শেখায়। এছাড়া আমার মতে ছাত্র রাজনৈতিক বিশ্বব্যাপী আন্দলোনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুষ্ঠু রাজনীতি করা শেখায়। তাই এর প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করার উপায় নেই। তবে লক্ষনীয় যে, স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি বিশেষত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার ছাত্র রাজনীতিকে বির্তকিত করছে। বিশেষত সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন দেশব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।

কিছু নামধারী ছাত্রনেতা নিজেদের ঠুনকো পরিচয়ে করেছে সিট বাণিজ্য, ডাইনিংয়ে বিনামূল্যে খাওয়া, বিভিন্ন ঠিকাদারের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করার মতো জঘন্য অপরাধ। এদের ক্ষমতার দাপটে সাধারণ শিক্ষার্থীরা হয়ে পড়তেন কোনঠাসা। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, এরা হত্যাযজ্ঞও চালিয়েছে।

বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে যেসব সংশয় দেখা দিয়েছে, খুব শীঘ্রই শক্ত হাতে এর সমাধান করতে হবে। ছাত্র রাজনীতিকে লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত করে জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে নিজেদের জায়গাটাকে শক্ত করতে হবে। ছাত্র রাজনীতির শুদ্ধতা এবং জৌলুস ধরে রাখতে পারলে ভবিষ্যতে এটি হবে সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময়।  (লেখক: আদিবা রহমান, শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ)