কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) প্রতি বছর ফুটবল টুর্নামেন্ট পূর্ণতা পায় শিক্ষার্থীদের মারামারিতে। কোনো না কোনো ম্যাচে শিক্ষার্থীদের মারামারিতে জড়ানো যেন রুটিনে পরিণত হয়েছে।
আবার এ মাঠের মারামারির রেশ এক হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আরেক হলের শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। অনেক সময় ব্যক্তি পর্যায়েও তা ছড়িয়ে পড়ে। পুরো ক্যাম্পাসই যেন হয়ে ওঠে ‘কুরুক্ষেত্র’।
সম্প্রতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহিদ আব্দুল কাইয়ুম স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টে-২০২৪ শুরু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) তুচ্ছ ঘটনায় সেখানেও মারামারির ঘটনা ঘটে। একই ঘটনার রেশ ধরে এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে অপর পক্ষা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়া আন্তঃবিভাগ ফুটবল টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল ম্যাচে খেলা চলাকালে ফাউল করাকে কেন্দ্র করে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে বাংলা বিভাগ ও মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা। যা পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই হলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে গড়ায়। এতে অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়।
এছাড়া ২০২৩ সালের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু কাপ আন্তঃবিভাগ ফুটবল প্রতিযোগিতায় আইন বিভাগ বনাম প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ফাইনাল ম্যাচ শেষে উত্তপ্ত পরিস্থিতির তৈরি হয়। ম্যাচে হেরে যাওয়া দল আইন বিভাগের কিছু শিক্ষার্থী রেফারির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং রেফারির দিকে তেড়ে আসলে প্রক্টরিয়াল বডি বাধা দেয়। এতে শিক্ষার্থী ও প্রক্টরিয়াল বডির মধ্যে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) শহিদ আব্দুল কাইয়ুম স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টে-২০২৪ এ লোকপ্রশাসন বিভাগ বনাম অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস (এআইএস) বিভাগের মধ্যে খেলা চলছিল। এ সময় ফার্মেসী বিভাগের খেলোয়াড় ইয়াসিন আরাফাত বাহিরে যাওয়া বল লাথি দিয়ে মাঠে দেয়। এ নিয়ে লোকপ্রশাসন ও ফার্মেসী বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
বলে লাথি দেওয়া ফার্মেসী বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়াসিন আরাফাত বলেন, ‘ওইদিনের খেলায় বলটা আউটলাইনের বাইরে চলে আসায় আমি বলটা তাদের নাগালের মধ্যে দেই। তখন কয়েকজন শিক্ষার্থী সন্ত্রাসী কায়দায় এসে আমাকে ধাক্কা দিতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেদের মধ্যে কিছু ডিসিপ্লিন, ক্রাইটেরিয়া থাকা উচিত; যা তাদের নেই। তাদের মধ্যে আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মতো যোগ্যতাই নেই।’
২০২৩ সালের ২ অক্টোবর প্রক্টরিয়াল বডি ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি
এদিকে, এরই জেরে রাতে একা পেয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করেন ফার্মেসী বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়াসিম সাকিবসহ কয়েকজন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্র মতে জানা যায়, জুম্মার নামাজের পর ম্যাজিক প্যারাডাইসের পাশের হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে যায় মাহিনুল ইসলাম। সেখানে ওয়াসিম সাকিব, সেজান খান এবং আনোয়ার জাহেদ খেতে যাচ্ছিল। এ সময় মাহিনুল ওয়াসিম সাকিবকে উদ্দেশ্য করে বৃহস্পতিবার খেলার ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করেন। পরবর্তীতে ওয়াসিম সাকিব মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে কথা কাটাকাটি শুরু হয়, এক পর্যায়ে তা হাতাহাতিতে গড়ায়।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী মাহিনুল ইসলাম বলেন, “কেন্দ্রীয় মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়ে আমার বন্ধুকে নিয়ে ম্যাজিক প্যারাডাইসের পাশের হোটেলে খেতে যাই। তখন আমার সঙ্গে সেজান ভাই, ওয়াসিম ভাই এবং আনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। তারা বিভাগ জিজ্ঞেস করলে আমি লোকপ্রশাসন-১৭তম ব্যাচ বলে পরিচয় দেই। পরে তারা আমাকে শারীরিক শিক্ষা স্কুলের বিপরীত পাশে থাকা ফাঁকা জায়গায় আমাকে নিয়ে যান এবং এলোপাতাড়ি মারধর করেন। একপর্যায়ে তাদের কারো হাতে থাকা চাবি আমার মাথায় লাগে এবং রক্তপাত শুরু হয়। পরে আমি প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সযোগে কুমিল্লা মেডিকেলে যাই।”
অভিযুক্ত ওয়াসিম সাকিব বলেন, “শুক্রবার জুম্মার নামজের পর ম্যাজিক প্যারাডাইসের পাশে হৃদয়ের দোকানে খেতে যায়। দোকানের প্রবেশ করার সময় লোকপ্রসাশন ১৭ তম আবর্তনের মাহিনুল বৃহস্পতিবার ফুটবল খেলার বিষয় নিয়ে আমাকে ইনসাল্ট করে বলে, ‘বৃহস্পতিবার যেইডারে মারছি, ওইডা মনে আছেনি।’ কেনো সে এ কথা বললো জানতে চাইলে সে আমার প্রতি মারমুখি আচরণ দেখায়, যা এক সময় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়।”
খেলার মাঠে শিক্ষার্থীদের মারামারির বিষয়ে ফার্মেসি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ড. প্রদীপ দেবনাথ বলেন, “টুর্নামেন্টে প্রত্যেক বিভাগের খেলায় সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। প্রক্টরিয়াল বডিকেও আরও সক্রিয় থাকতে হবে। শিক্ষার্থীরা নিজেরা সংযত না থাকলে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মোকাবিলা করা সম্ভব না।”
একই বিষয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মোসা. শামসুন্নাহারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “খেলায় জয়-পরাজয় বড় বিষয় না। পরিচ্ছন্ন খেলাই মুখ্য বিষয়। এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাউন্সিলিং করা যেতে পারে। উভয় পক্ষকেই শান্ত থাকতে হবে। উত্তেজিত হয়ে মাঠে নামা যাবে না।”
এদিকে, তুচ্ছ ঘটনায় খেলার মাঠে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারির নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এ বিষয়টি ভালোভাবে দেখছেন না বলে মত দিয়েছেন।
জয়ী হওয়ার মানসিকতাই প্রতি টুর্নামেন্টে উদ্ভূত পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণ বলে ভাবছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, “পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তুলতে এবং বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির উদ্দেশ্যে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়। এতে শরীর ও মন যেমন ভালো থাকে, তেমনি তৈরি হয় একটা সুস্থ মানসিকতার পরিবেশ। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্য যে, প্রতিবছরই টুর্নামেন্টগুলো থেকে এক ধরনের উদ্ভূত পরিস্থিতি তৈরি হয়, যা খুবই দুঃখজনক। এটা বেশি দেখা যায় ফুটবল টুর্নামেন্টে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়, এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়।”
খেলোয়াড়দের আচরণবিধি নিয়ে ক্রীড়া কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোহরাব উদ্দিন বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশের সবচেয়ে গুণগত মানসম্পন্ন নাগরিক। শিক্ষার্থীদের এমন আচরণ অশোভন। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে টারশিয়ারি শিক্ষা নিতে। তাদের আচরণ আপামর জনতার মতো হওয়া উচিত নয়।”
তিনি বলেন, “আমাদের শিক্ষার্থীদের সহনশীল হতে হবে। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক এবং দেশ উন্নয়নের হাতিয়ার যাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, তারা অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাই সংঘর্ষে না গিয়ে সমস্যা সমাধানের মানসিকতা রাখতে হবে।”
শিক্ষার্থীদের এমন অসদাচরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. আবদুল হাকিম বলেন, “শিক্ষার্থীদের এমন আচরণ খুবই দুঃখজনক। শিক্ষার্থীদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আচরণ আরও সহনশীল হওয়া উচিত।”