ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে প্রত্যাবর্তন শুধু মার্কিন রাজনীতির জন্য নয়, বিশ্ব রাজনীতিতেও একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। তার এ জয় যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি বৈশ্বিক কৌশলগত ও ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কেও নতুন সমীকরণ তৈরি করবে।
গত ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৭৮ বছর বয়সী রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড জন ট্রাম্প আবারও হোয়াইট হাউজের চাবি পেলেন। আমেরিকার ইতিহাসে এটি ছিল একটি নাটকীয় প্রত্যাবর্তন। আধুনিক মার্কিন নির্বাচনের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো কোনো প্রেসিডেন্ট যিনি এক মেয়াদের বিরতির পর পুনরায় নির্বাচিত হলেন। এর আগে স্টিফেন গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড ১৩০ বছর আগে এ কীর্তি গড়েছিলেন।
বুথ ফেরত জরিপগুলোতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী এবং বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে এগিয়ে রাখা হলেও ফলাফল হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত। ট্রাম্প ৩১২ ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে প্রয়োজনীয় ২৭০ ইলেকটোরাল ভোটকে ছাড়িয়ে যান। এমনকি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সুইং স্টেট— অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাডা, নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিনে জয়ী হয়েছেন। এই সুইং স্টেটগুলো বরাবরই মার্কিন নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখে।
ট্রাম্পের জয়ের পেছনে কয়েকটি নির্দিষ্ট কারণ কাজ করেছে, যা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। যার মধ্যে, অর্থনীতি ও মুদ্রাস্ফীতি অন্যতম। মার্কিন অর্থনীতি ছিল এবারের নির্বাচনের কেন্দ্রবিন্দু। মহামারি-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি ৭০-এর দশকের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়, যা ২০২৩ সালে ছিল ৬.৫ শতাংশ। সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উচ্চমূল্যের কারণে চাপে পড়েছেন।
এছাড়া বেকারত্বের হার ২০২২ সালে ৫.২ শতাংশে পৌঁছে যায়, যেখানে মহামারির আগে তা ছিল মাত্র ৩.৫ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রচারণায় অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মধ্যবিত্ত এবং শ্রমজীবী আমেরিকানদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন।
ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতি তার সমর্থকদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা জাগিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসন এবং সীমান্ত নিরাপত্তা ইস্যুতে তিনি আগের মেয়াদে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। এবারও তিনি একই নীতি অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দেন, যা তার অনেক সমর্থকের মন জয় করে।
ট্রাম্প ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন সমর্থন হ্রাস করার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি এ যুদ্ধকে ‘অপ্রয়োজনীয় ব্যয়’ হিসেবে উল্লেখ করেন। এর পাশাপাশি গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন এবং মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়েও তার বক্তব্য আমেরিকান ভোটারদের মধ্যে সাড়া ফেলে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের পরিচিতি এবং তার সরাসরি বক্তৃতার ধরনও অনেক ভোটারকে আকর্ষণ করেছে। তার নেতৃত্বের দৃঢ় অবস্থান এবং জাতীয়তাবাদী নীতিগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে ভরসা তৈরি করেছে।
মূলত মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলায় তার প্রতিশ্রুতিগুলো মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী আমেরিকানদের আস্থা অর্জনে সাহায্য করেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতিমালায় পরিবর্তন আনার পাশাপাশি বৈশ্বিক রাজনীতিতেও নতুন সমীকরণ তৈরি করবে। তার আগের মেয়াদে চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছিলেন। এবারও চীনের প্রযুক্তি এবং সামরিক সম্প্রসারণ মোকাবিলায় তিনি কঠোর অবস্থান নিতে পারেন।
তবে তার ইসরায়েলপন্থী নীতি মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়াতে পারে। তার আগের জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুনরায় আলোচনার কেন্দ্রে আসতে পারে। এছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলোকে ন্যাটোর প্রতিরক্ষা খরচ বাড়ানোর জন্য চাপ দিয়েছিলেন, এবারও তিনি এ চাপ অব্যাহত রাখবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে; যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন রূপ তৈরি করবে।
রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ট্রাম্প হয়তো আরও নমনীয় অবস্থান নিতে পারেন। ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সামরিক সহায়তা হ্রাস করার প্রস্তাব রাশিয়াকে একটি কৌশলগত সুবিধা দিতে পারে। অন্যদিকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং ভূ-রাজনীতি নির্ভর হতে পারে। অবশ্য ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে বাণিজ্য চুক্তিতে জটিলতা বাড়লেও চীনের বিরুদ্ধে উভয় দেশের কৌশলগত সহযোগিতা জোরদার হবে।
ভারতের সঙ্গে সামরিক অংশীদারিত্ব, যেমন কোয়াড জোট, আরও শক্তিশালী হতে পারে। তবে অভিবাসন নীতি কঠোর হলে ভারতের প্রযুক্তি খাতে প্রভাব পড়তে পারে। কারণ এই খাত মার্কিন এইচ-১বি ভিসার ওপর নির্ভরশীল। ২০২০ সালের মতোই দুই দেশের মধ্যে ব্যক্তিগত রসায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলে পুনঃনির্বাচনের ফলে কিছু অর্থনৈতিক ও ভিসা ইস্যুতে উত্তেজনা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বরাবরই সংশয় প্রকাশ করেছেন এবং মানবসৃষ্ট কারণগুলোকে তিনি গুরুত্ব দিতে চাননি। তার প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস চুক্তি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, যা বিশ্বজুড়ে তুমুল সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। ট্রাম্প জীবাশ্ম জ্বালানিকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণের পরিবর্তে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে বেশি জোর দিয়েছিলেন।
তার নীতিতে পরিবেশগত নিয়ম শিথিল করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব উপেক্ষার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। তাই পরিবেশবাদীদের ধারণা পুনঃনির্বাচনের পরও তিনি হয়তো এ নীতিগুলো বজায় রাখবেন, যা বৈশ্বিক জলবায়ু প্রচেষ্টায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং বিশ্ব নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলতে পারে।
তার অর্থনৈতিক নীতিগুলো বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রীক, যেখানে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ দর্শন প্রাধান্য পেয়েছে। প্রথম মেয়াদে তিনি চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেন, যা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রভাব ফেলে। ট্রাম্প কর্পোরেট কর কমিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করেন। পুনঃনির্বাচনের পরও তিনি বাণিজ্যে শুল্কনীতি কঠোর করতে পারেন এবং চীনের প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ প্রতিরোধে উদ্যোগী হবেন।
২০১৮ সালে চীনা পণ্যে ৩৬০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের শুল্ক আরোপ তার কঠোর বাণিজ্য নীতির উদাহরণ। তবে এ ধরনের পদক্ষেপ বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জটিল করে তুলতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, বৈশ্বিক রাজনীতির জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের সূচনা। তার দ্বিতীয় মেয়াদে অর্থনীতি, ভূ-রাজনীতি এবং জলবায়ু নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। বিশ্ব এখন তার নেতৃত্বের গতিপথের দিকে গভীরভাবে নজর রাখছে।
প্যারিস চুক্তি, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা ও ন্যাটো জোটের ভবিষ্যৎ— এ সবই তার নীতির আলোকে নতুন সমীকরণ তৈরি করবে। বৈশ্বিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা তার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে। ট্রাম্পের নীতি বিশ্বে স্থিতিশীলতা আনবে নাকি নতুন উত্তেজনার জন্ম দেবে, তা সময়ই বলে দেবে। এক নতুন অধ্যায়ের অপেক্ষায় রয়েছে বিশ্ব।
লেখক: শিক্ষার্থী, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়