ঢাকার যাত্রাবাড়ীর ডা. মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের (ডিএমআরসি) এইচএসসি পরীক্ষার্থী অভিজিৎ হালদারের (১৮) মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীর ২৯ কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে সোহরাওয়ার্দী কলেজে চলমান অনার্স প্রথম বর্ষের ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
রোববার (২৪ নভেম্বর) দুপুরে ভুল চিকিৎসা ও অনিয়মের মৃত্যু হয়েছে অভিযোগ তুলে ঢাকার কলেজগুলোর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের অন্তত ২৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ সংঘর্ষে জড়ান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভুল চিকিৎসায় অভিজিতের মৃত্যুর অভিযোগে গত বুধবার (২০ নভেম্বর) থেকে ডিএমআরসি কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন। গত বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) কবি নজরুল কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদলের নেতৃত্বে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয়।
রোববার (২৪ নভেম্বর) দুপুরে ডিএমআরসি কলেজের নেতৃত্বে অন্তত ২৭ কলেজের ৫ হাজার শিক্ষার্থী পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিক্যাল হাসপাতাল ঘেরাও করেন। এ সময় হাসপাতালের পাশে অবস্থিত কবি নজরুল কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ হামলায় কবি নজরুল কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদল নেতৃত্ব দেয় বলে জানা গেছে।
পরে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা পিছু হটে সোহরাওয়ার্দী কলেজে আশ্রয় নেন। এ সময় তাদের ধাওয়া দিতে দিতে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ঘেরাওয়ে আসা শিক্ষার্থীরা সোহরাওয়ার্দী কলেজে ঢুকে পড়েন।
এ সময় কলেজটিতে অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা চলছিল। কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা এ কলেজে পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢুকে পড়লে সোহরাওয়ার্দী কলেজে পরীক্ষার্থী ও শিক্ষার্থীরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন।
এ সময় কলেজের উপাধ্যক্ষের রুমসহ অধিকাংশ কক্ষে ভাঙচুর চালান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। কলেজ প্রাঙ্গণে থাকা একটি প্রাইভেট কার, মাইক্রেবাস ও অ্যাম্বুলেন্স, দুটি মোটর সাইকেল ভাঙচুর করেন তারা। এ সময় তাদের কলেজের ট্রফি, চেয়ারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে যেতে দেখা যায়। পরে শিক্ষক ও স্টাফদের অনুরোধে তারা সোহরাওয়ার্দী কলেজ প্রাঙ্গণ ছেড়ে দেন।
এদিকে, সোহরাওয়ার্দী কলেজে দুপুর সাড়ে ১২টায় শুরু হওয়া কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা ২ ঘণ্টা চলার পর নিরাপত্তার স্বার্থে তা স্থগিত করা হয়।
কবি নজরুল কলেজের ছাত্র মুফতি বলেন, “পরীক্ষা দেড়ঘণ্টা চলার পর আমরা ভাঙচুরের শব্দ পাই। এরপর ২ ঘণ্টা পর দুপুর আড়াইটা নাগাদ শিক্ষকরা পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করেন।”
অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের এ সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত একজন সাংবাদিকসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থীর আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে ঘটনাস্থলে পুলিশ ও সেনাবাহিনী সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়নি। আহতদের আশপাশের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছে বলে জানা গেছে।
আন্দোলনরত ডা. মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র সানোয়ার বলেন, “আমরা আমাদের অভিজিৎ ভাইকে হারিয়েছি। ঢাকার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ভুল চিকিৎসা দেওয়ার কারণে তিনি মারা গেছেন। আমরা গত বৃহস্পতিবার প্রতিবাদ করলে কবি নজরুল কলেজের ছাত্রদলের নেতারা আমাদের মারপিট করেন। আজ প্রায় সব কলেজ মিলে এ অন্যায়ের প্রতিবাদ জানালে সোহরাওয়ার্দী-নজরুলের শিক্ষার্থীরা অতর্কিত হামলা চালান। আমার তিন সহপাঠীর মাথা ফেটে গেছে।
অপরদিকে, দুপুরে ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল হাসপাতালের প্রধান ফটক আটকানো থাকায় উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা বাইরে ভাঙচুর শুরু করেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বুঝানোর চেষ্টা করতে গেলে তারা ভুয়া ভুয়া স্লোগান দিতে থাকেন। পরে বিকাল ৪টার দিকে ঢাকার কলেজগুলোর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে সেচ্ছায় চলে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
সোহরাওয়ার্দী কলেজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সোহরাওয়ার্দী কলেজে ঢুকে ব্যাপক হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে। পুরো কলেজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গাড়ি, ক্লাসরুম, অফিস থেকে শুরু করে হামলা থেকে কোনোকিছুই বাদ যায়নি। এ হামলার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের স্নাতক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা পুরো পরীক্ষা শেষ করতে পারেননি। হামলার বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় বলেন, “আজ পরীক্ষা ছিল। গতকাল রাত পর্যন্ত কলেজের প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলল, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেছে, কিছু হবে না। দুপুর সোয়া ১টায় কিছু বোঝার আগেই সিসিটিভিতে দেখি প্রচুর ছেলেমেয়ে এসেছে এবং গেট ভেঙে ঢুকে ইচ্ছামতো ভাঙচুর করেছে।”
তিনি বলেন, “হামলার সময় প্রশাসনের কেউ এগিয়ে আসেনি, এমনকি এখন পর্যন্তও আসেনি। একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের বড় ক্ষতি হয়ে গেল। একটি পাবলিক পরীক্ষা চলমান ছিল। তারপরও কেনো হামলার ঘটনা ঘটেছে সে ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না।”
তিনি আরও বলেন, “কলেজের কোনো অফিস এবং কোনো বিভাগের কক্ষই অক্ষত নেই। পুরো কলেজ এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। দুজন শিক্ষকের ব্যক্তিগত গাড়ি এবং কলেজের গাড়িটি ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হয়েছে। গ্যাস লাইন ছেড়ে দিয়েছে। এরা কি ছাত্র হতে পারে? এত নাশকতা তো ছাত্ররা করতে পারে না।” ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ এ মুহূর্তে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, তবে বিস্তারিত জানানো হবে বলে জানান অধ্যক্ষ।
লালবাগ জোনের ডিসি জসিম উদ্দিন বলেন, “গত ১৮ তারিখে মাহবুবুর রহমান কলেজের একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলে আমরা জানতে পারি। ওইদিনই কলেজের শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে এসেছিল। এ ঘটনায় একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এরপরেও গত বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীরা অধিক সংখ্যায় আসে। শিক্ষার্থীদের দাবি অবহেলাজনিত মৃত্যু হয়েছে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বার বার বলেছে, আমরা শিক্ষার্থী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সঙ্গে নিয়ে তদন্ত করব। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চাপের মুখে রাখা হয়।”
তিনি বলেন, “আজ হাসপাতালে মিটিং ছিল। সেখানে ছাত্র প্রতিনিধি, মৃতের বাবার আসার কথা ছিল। কিন্তু তারা আসেনি বলে জানতে পেরেছি। এদিকে আজ আবার সকালে শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে এসেছে। তারা যাত্রবাড়ি থেকে অনেক সংখ্যায় এসেছে। সকাল থেকেই আমরা তাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছি। অবশেষে আমরা সংখ্যা বাড়িয়ে বিকেলে তাদের বুঝাতে সক্ষম হই এবং তারা চলে যায়।”
সামনে আবার হামলা হতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য নেই।”