ক্যাম্পাস

সংবিধান রূপান্তর নিয়ে যা ভাবছেন শিক্ষার্থীরা

সংবিধান একটি রাষ্ট্রের মৌলিক আইন। রাষ্ট্রের জনগণের ইচ্ছা-অভিপ্রায়ের প্রকাশের জন্য জনগণের অংশগ্রহণেই প্রণিত হবে সংবিধান। কথা ছিলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। সংকট সম্ভাবনার সময়ে প্রশ্ন উঠেছে সংবিধান কেমন হবে। সে সম্পর্কে নানা মতামত দিয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

‘সংবিধান হবে মৌলিক অধিকারের রক্ষক’ সংবিধান বলতে আমরা বুঝি, মৌলিক নীতি-প্রতিষ্ঠিত নজিরগুলোর সমষ্টি। যা একটি রাষ্ট্র, সংস্থা বা অন্য ধরনের সত্ত্বার আইনি ভিত্তি গঠন করে এবং সেই সত্ত্বাকে কীভাবে পরিচালিত করা হবে তা নির্ধারণ করে থাকে। এক কথায় সংবিধান হলো মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষক। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সর্বোত্তম রক্ষাকবচ।

কিন্তু বর্তমান সংবিধান হলো আওয়ামীপন্থী। সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদের ১০২ অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার এখতিয়ার দিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা তা ব্যবহার করেছে নিজের জন্য। অনান্য দেশের মতো বাংলাদেশে সংবিধান থাকলেও ইতোপূর্বে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার সেটাকে তার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফলে ছাত্র জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারকে।

ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে এ দেশের সংবিধানকে নিজের মতো করে সাজিয়ে রাখায় তা যথাযথভাবে প্রয়োগ হয়নি। সংবিধান বা গঠনতন্ত্র প্রয়োগে স্বৈরাচারী পতিত আওয়ামী লীগ সরকার স্বেচ্ছাচারিতা করায় এ দেশের সাধারণ জনগণ তাদের নাগরিক অধিকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ মানুষেরা ন্যায় বিচার পাননি, অবিচার আর শোষণের শিকার হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে বারংবার নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে।

শুধু তাই নয়, সংবিধান অনুযায়ী নিরেপক্ষ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও স্বৈরাচারী সরকার সংবিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমে রাতের আধারে ভোট চুরি করে দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছেন। শিক্ষা, চাকরি, ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এ দেশের মানুষ। বিশেষ করে যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না, তারাই বেশি নিপীড়িত হয়েছে। দ্রুত দেশের সংবিধান সংস্কার বা বাতিল করে পুনরায় নতুন গনতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন প্রয়োজন।

এ দেশের মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাস, বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার নতুন একটি গনতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করবে। যা এদেশের মানুষের সামনের দিনগুলোর জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ এবং দৈনন্দিন শান্তি শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করবে।

(লেখক: জেসিনা মুর্শীদ প্রাপ্তি, ইংরেজি সাহিত্য বিভাগ, সরকারি মহিলা কলেজ, যশোর।

‘মীমাংসিত বিষয় অক্ষুণ্ণ রেখে সংশোধন করতে হবে’ সংবিধানের মীমাংসিত বিষয়গুলো অক্ষুণ্ন রেখে সংশোধন করার মাধ্যমে দেশকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পথে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

পাশাপাশি নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনসভার ক্ষমতার পৃথককরণ করতে হবে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ভালো নির্বাচন করা সম্ভব ছিল। সেটি অপপ্রয়োগ হলেও মেরামত করা যেত। তবে সেটিকে বাধাগ্রস্ত করে এমনভাবে নির্বাচন ব্যবস্থা নষ্ট করা হয়েছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনগুলো প্রহসনে পরিণত হয়েছে।

২০২৪ সালের ‘ডামি নির্বাচন’ও তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাংবিধানিক সংস্কার করতে হবে যাতে বিচার বিভাগের ক্ষমতা খর্ব না হয়, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয় এবং গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। নতুন নতুন আইন করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও ক্ষুণ্ন হয়েছে। এজন্য, সংবিধানের আরও গণতান্ত্রিকীকরণ ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। ভবিষ্যতে যেন কোনো স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে না পারে, সে লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন করা প্রয়োজন।

(লেখক: লাবিব বিন শাহেদ, কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়)

‘ন্যায়বিচারের সংবিধান প্রয়োজন’ বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি, সংবিধানের সমস্ত ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে; যা বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদী শাসনের উপযোগী করে তুলেছিল। যার মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত অধিকার প্রতিষ্ঠা না হয়ে বরং তাকে অধিকারহীন করে ফেলা হয়েছিল। ফলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে সে ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করা হয়েছে।

পতিত ফ্যাসিবাদ পরবর্তী সময়ে এখন আমাদের এমন সংবিধান দরকার, যা জনগণের সব গণতান্ত্রিক অধিকারকে সংরক্ষণ করে, সর্বস্তরে জবাবদিহীতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়। প্রতি স্তরে মানুষের অধিকার সম্যকভাবে নিশ্চিতের লক্ষ্যেই এ সমাধান দ্রুত প্রয়োজন।

(লেখক: সীমা আক্তার, সংগীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)

‘রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্যই সংবিধান’ সংবিধানের যত কালো কানুন আছে, তা নসাৎ করতে হবে। পরবর্তীতে কোনো ক্ষমতাসীন দল যাতে নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন হয় এমন কোনো আইন যাতে সংসদে পেশ করতে না পারে, এর জন্য সংবিধান এ আলাদা বিধান থাকতে হবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গে যাতে রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের সুপারিশে কিংবা কোনো ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবে যেন কেউ নিয়োগ না পায় এর জন্য আলাদা বিধান তৈরি করতে হবে।

ধারা-৭ এ বলা হয়েছে, সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। এ ধারার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয় না এমন কোনো ধারা সংবিধান এ লিপিবদ্ধ হতে দেওয়া যাবে না। এমনকি আমলাতন্ত্রকে তার কাজের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দিতে হবে। কোনো অনৈতিক হস্তক্ষেপ তার কাজে বাধা দিলে আমলারা যেন তা প্রতিহত করতে পারে, সে ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। কখনো প্রশাসনিক কর্মকর্তা যেমন- পুলিশ, বিজিবি ইত্যাদিক তারা যেন আইন বহির্ভূত কোন কার্যকলাপ কিংবা সরকার দলীয় কোনো নেতৃত্বের দেওয়া অবৈধ আদেশকে প্রয়োগ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করে হবে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রুপান্তরের জন্য সংবিধান পরিবর্তন আবশ্যক।

(লেখক: তাওহীদ আহমদ সালেহীন, আইন বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়)